Friday, 24 April 2015

প্রবন্ধ : রবীন্দ্র সাহিত্যে নারীমুক্তি- প্রথম সোপান

রবীন্দ্র সাহিত্যে নারীমুক্তি- প্রথম সোপান 
শ্রাবণী রায়
শাস্ত্রে মেয়েদের বলা হয় ‘পূজাৰ্হা গৃহদীপ্তয়’।কিন্তু রবীন্দ্রচেতনায় নারীকে 
গৃহলক্ষ্মীর সম্মানে অধিষ্ঠিত দেখার চেয়ে পুরুষের হৃদয়েশ্বরীরূপে দেখার 
প্রবণতাই বেশী। যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকরা  নারীকে তাদের
কাব্য প্রেরণার উৎস করেছেন, তাদের মধ্যে আপন মানসীকে প্রত্যক্ষ করেছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত কেউই নারীকে আত্মস্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেন নি । রবীন্দ্রনাথ র্তার সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকে পূর্বসূরীদের চোখেই নারীকে দেখেন এবং পুরুষের প্রেরণা এবং প্রেয়সী রূপেই আঁকার চেষ্টা করেন কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গীর কিঞ্চিৎ পরিবর্তন প্রথম দেখা যায় চোখের বালি উপন্যাসের বিনোদিনী চরিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে। বৈধব্য নারী জীবনের এক অভিশাপ,দুর্ভাগ্য বলেই ব্যাখ্যা করেছেন প্রাক্তন সাহিত্যিকরা এমন কি বঙ্কিমচন্দ্রও রোহিণীর জীবনতৃষ্ণাকে  সেভাবে সমর্থন করতে পারেননি । কুন্দনন্দিনীকেও অকালে সরে যেতে হয়েছে । কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্রকে প্রলুব্ধ করেছে অথচ বিহারীর প্রেম তার উদ্দেশ্যেই ঝরে পড়েছে। বঞ্চিত নারীত্বের যন্ত্রণাকে সমবেদনাকাতর মন দিয়ে একেছেন রবীন্দ্রনাথ। "জগতে আমার ভালোবাসিবার এবং ভালবাসা পাইবার কোন স্থান নাই। তাই আমি খেলা খেলিয়া ভালোবাসিবার খেদ মিটাইয়া থাকি।” অবশ্য  নৌকাডুবি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রাক্তন পথেই যাত্রা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রচেতনায় নারীর সর্বোত্তম পরিচয়, সে পুরুষের আত্মবিকাশের মাধ্যম। প্রেমোপলব্ধি ছাড়া পুরুষের - জীবন যে ব্যর্থ, অসম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ তা প্রথম দেখান  চোখের বালিতে তারপর গোরা, ‘ঘরেবাইরে’ এবং চতুরঙ্গ উপন্যাসে তারই ক্রমবিকাশ। বিনোদিনীর ভালোবাসাই বিহারীর একপেশে জীবনের অন্ধত্ব মোচন করেছিল,কিন্তু গোরার জীবনে সুচরিতার দান অনেক বিস্তৃত । যে গোরাকে দিয়েছে নব ভারতবর্ষের চেতনা । যে নারীর স্থান গোরার জীবনে শুধু ছিল মার ঘরে,সতীলক্ষ্মী গৃহিণীর আসনে, তাকে সুচরিতা  প্রতিষ্ঠা করেছে ব্যক্তির হৃদয় মন্দিরে, ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী সমস্ত মঙ্গল ভাবনায় । তাই সুচরিতার হাত ধরেই গোরা তার নতুন উপলব্ধিতে উন্নীত হতে চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন “রমণীর মন,/ সহস্র বর্ষেরই সাধনার ধন” তাই বিমলার প্রেমও জয় করতে হয়েছে নিখিলেশকে অনেক যন্ত্রণার সমুদ্র পার হয়ে। বিবাহিতা স্ত্রীর প্রেমও বিধাতার দানের মতো অনায়াসলব্ধ এবং নিষ্কণ্টক বলে সে তার মর্যাদা হারায়। তাই সন্দীপের মোহমুক্ত বিমলাকে অনেক কান্নার মূল্যে হারিয়ে পেয়েছে নিখিলেশ । তেমনি শচিশের অসীম সাধনা অসম্পূর্ণ থেকেছে যতদিন না দামিনীর প্রেম তার কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতাপকে ভালোবাসার অপরাধে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চন্দ্রশেখর উপন্যাসের নায়িকা শৈবলিনীকে উন্মানীির শাস্তি দিয়েছেন কিন্তু শচীশের প্রতি দামিনীর আকণ্ঠ পিপাসাকে জীবনের ধর্ম বলে গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যপূর্বা  বিধবা দামিনীর জীবনকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে দিয়েছে শ্রীবিলাসের প্রেম। দামিনীর জীবনাকাঙ্খাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে তাকে শ্রীবিলাসের অর্ধাঙ্গিনীরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তার চতুরঙ্গ উপন্যাসে। এখানেই তার নারী চেতনার বৈশিষ্ট্য। নারীকে একদিকে যেমন তিনি ভোগ্যপণ্য হিসাবে ভাবেন নি, অন্যদিকে রোমান্সের ছায়ায় সহচরী করে এঁকেও  তার কর্তব্য সমাপ্ত করেন নি। নারী তার কছে জীবনের সমার্থক, প্রাণের উৎস।
রবীন্দ্রনাথের এই নারী ভাবনা আরো সোচ্চার হয়ে ওঠে "রক্ত করবী”র মঞ্জরীর লালিমায় নন্দিনীর ধানী রঙের আঁচলের ছায়ায় আচ্ছন্ন সমগ্র নাটক তথা তার সমস্ত চরিত্রগুলি। নন্দিনীর মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়েই বিশু গেয়ে উঠতে পারে, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি / এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাশি।’
রঞ্জনের যৌবনের আবেগও বাধনহারা হয়ে ওঠে নন্দিনীর প্রাণ কোলাহলে। তবে সবচেয়ে তোলপাড় ওঠে রাজার নিয়মানুগ যন্ত্ৰজগতে। নন্দিনীকে ভালোবেসে যন্ত্রের দাসত্ব অসহ্য হয় রাজার। Superman এর অসামান্য ক্ষমতার আড়ালে যে বন্ধন, যে মানবতার অবমাননা তা রাজাকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে নন্দিনীর প্রাণের সংস্পর্শেই। তাই এক নারীকে ভালোবেসে মাটির মায়ায় ফেরেন রাজা, নিজের বন্ধন নিজে ছিন্ন করে নিজের সৃষ্টির  বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নারী এখানে প্রাণ এবং ভালোবাসার প্রতীক, সে যন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজেতা ঘোষণা করে।
চলবে

No comments:

Post a Comment