Friday, 24 April 2015

প্রবন্ধ : কিছু নাটকেয় প্রসঙ্গ - সঞ্চয়ন ঘোষ

কিছু নাটকেয় প্রসঙ্গ

সঞ্চয়ন ঘোষ


 ঘাসের উপর খালি পায়ে হেঁটে দেখবেন, সিমেন্ট লেপা ছাদে অথবা পিচের রাস্তায়, এমনকি 
মোজাইক করা মেঝে আর এমনি লাল মেঝেতে একটু খেয়াল করলে দেখবেন প্রত্যেকে আলাদা কথা বলছে। আসলে প্রত্যেকের গঠন চরিত্র আলাদা, তাই আলাদা ভাষা, আলাদা অনুভূতি। যেকোনো শিল্পে শিল্প মাধ্যমের কথা বলার ক্ষমতা আছে। আর এই ভাষা কেবল শৈল্পিক অভিব্যক্তিকে প্রভাবিত করে তা নয়, শৈল্পিক চরিত্রকেও বদলে দেয়। তাই কোনো শিল্প তখনই উৎকর্ষতা লাভ করে যখন শিল্প মাধ্যমের চরিত্র শিল্প আঙ্গিকের মূল নির্ধারণ করে। বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় এবং রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পকর্ম দেখলে বোঝা যায় কীভাবে শিল্প মাধ্যম শিল্পের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। তখন সে মানুষের হাত হােক আর ধানের গুচ্ছ হোক বা গাছের পাতা, সে আর শুধু চোখে দেখা প্রকৃতির দান নয়, মাধ্যম তাকে এক নতুন জীবন দিয়েছে, দিয়েছে নিজস্ব অস্তিত্ব। যার বেড়ে ওঠা নিজস্ব ছন্দে নিজস্ব গতিতে। সেখানে জন্ম নিয়েছে এক কাব্যিকতা যার অনুভূতি চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় আর বস্তুর অস্তিত্বে। চুন সুরকির উপর আঁকা বা কংক্রিটের মুখ তখন আর শুধু মুখ নয়, যেন প্রতিনিয়ত নির্দিষ্ট করে তাদের গড়ে ওঠার  ইতিহাস, প্রতিটি মুহূর্তের চরম নাটকীয়তা।  
কলাগাছে কলাবউ, পিচের ড্রামে কালাচাঁদ
               বাড়িতে প্রত্যেক লক্ষ্মী পূজায় কলাগাছ আনা হয়, সঙ্গে একটা মাঝারি  ধরনের আখের টুকরো আর একজোড়া সুপুরি। এই কলাগাছ থেকে বানানো হয় কলাবউ । দায়িত্ব বাড়ির বড়ো ছেলের। কলাগাছের গোড়া কেটে সযত্নে কলা গাছের খোল দিয়ে মুড়িয়ে পা বানানো হয়। পায়ে গোজা বিভিন্ন গাছের নমুনা, যেমন ধান, মান, কলা, কচু, সুপুরি প্রভৃতি। তারপর কলাগাছের মাঝামাঝি অংশের একটু উপরে, প্রায় যেখান থেকে পাতা আরম্ভ হয় তার একটু নীচে আখের অংশ হলো হাত আর তার সাথে একজোড়া সুপুরি বেঁধে তৈরি হলো বউয়ের বক্ষ। এরপর সব পাতা একসঙ্গে পেচিয়ে বেকিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো আখের সাথে আর সেইসঙ্গে হয়ে গেল ঘাড় গোঁজা কলাবউ, বংশের কুলবধূ । তারপর ভালো করে স্নান করিয়ে, নতুন শাড়ি পরিয়ে ঘরে তোলা হলো। বাড়ির ছেলে যখন কলাগাছ সাজাত, মায়েরা সাবধান বাণী শোনাতেন গাছ যেন ছোট্ট হয়, হয়, সাজানো যেন সুন্দর হয়, নইলে ছেলের বউ ভাগ্য ভালো নয়। আর সেই ছেলে নিজের হাতে নিজের বউ বানিয়ে নিত। বিশ্বাসে ছেলে হয়ে  যেত গণেশ আর কলাগাছ তার কলাবউ। অনেকে বলবেন এসব পুরাণের গল্প আরঅন্ধ সংস্কার।এর পিছনে যে কাহিনী বা বিশ্বাস থাকুক না কেন, একটা গাছের মানবী হয়ে যাওয়া আমার কাছে অদ্ভুত, সুন্দর এবং অভিনব। হয়তো অনেক সংস্কার এবং সামাজিক নৈতিকতার রাজনীতি এই প্রক্রিয়ার মূলে আছে, কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় মানুষের তার চারপাশের অস্তিত্বকে মানবীকরণ করে নেওয়ার প্রক্রিয়া, আর তাই গাছ হয়ে যায় মানুষ।

        কলাগাছের কলাবউ হয়ে যাওয়াটা শুধু কোনো বিশ্বাস বা ধর্মীয় মতবাদের প্রভাব নয় এটা মানুষের এক সহজাত কাব্যিক প্রবণতা যার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে নয় অভিজ্ঞতায় আর অস্তিত্বে। তাই কলাগাছে হয় কলাবউ আর পোড়া পিচের ড্রামে কালাচাদ।

কিছু নাটকেয় প্রসঙ্গ

         সাধারণত যখন কোনো বস্তু ব্যবহার করা হয় তার চরিত্র নির্ধারিত হয় বস্তুর ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতার উপর। তার বস্তুপদার্থ, তার আকার, বা Structural Pattern নির্ভর করে বস্তুটি কোন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর। যেমন কোন দেওয়াল কেমন হবে, কী দিয়ে বানানো হবে তা সবই নির্ভর করবে দেওয়াল, বাড়ির বাইরের দেওয়াল না ভিতরের দেওয়াল, বাইরের হলে মোটা ভিতরের হলে পাতলা আবার দেওয়াল রাজস্থানে হবে না বাংলায় তার উপর নির্ভর করবে পাথর না ইট। এই সমস্ত প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হলে তবে কথা উঠবে দেওয়ালের বাইরেটা কেমন দেখতে হবে। যে কোনো ব্যবহারিক বস্তুর সৌন্দর্য বিশ্লেষণ তার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাকে পূর্ণ করার পরই ভাবা হয়। কিন্তু কোনো শৈল্পিক অভিব্যক্তির প্রয়োজনে ব্যবহৃত বস্তুর আকার, রূপ সবসময় তার বাস্তব প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে নাও হতে  পারে, সেক্ষেত্রে শৈল্পিক প্রয়োজনীয়তাই তার আকার, বা বস্তুপদার্থকে নির্ণয় করবে। বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে বস্তুপদার্থ একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নেয়।

           এই প্রসঙ্গে শৈল্পিক অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে বস্তুপদার্থের গুরুত্ব সম্পর্কে স্বল্প আলোচনা প্রয়োজন। ভারতীয় ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বস্তুপদার্থকে একটা বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। ভারতীয় ভাস্কর্যে পাথর কেবল বস্তু নয়, তার নিজস্ব একটা অস্তিত্ব আছে। তাই ভারতীয় ভাস্কর্যে পাথর দিয়ে মূর্তি বানানো হয় না। পাথরে মূর্তির প্রাণ সঞ্চার করা হয়। তাই কোনো মূর্তিই পাথরের নিজস্ব চরিত্রকে হারায় না। পাথরের দৃঢ়তা, তার কঠিনতা, তার কোমলতা তাই মূর্তির একটা অঙ্গ। ভারতীয় ভাস্কর্য কোনো বাস্তব রূপের প্রতিফলন নয়, প্রসারণ। বস্তুর নিজস্ব চরিত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার এই ধারণা ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং লোকাচারের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে দেখা যায় যে বস্তুর ব্যবহার অনুষ্ঠানের অনন্য অঙ্গ তো বটেই এমন কী মতাদর্শের সাথেও জড়িত, যার মূলে আছে একটা অনেকদিনের বিশ্বাস এবং পারিপার্শ্বিক ভৌগোলিক এবং সামাজিক অবস্থান।
            বেশিরভাগ লোকাচারে বস্তুপদার্থের ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বাসকে প্রগাঢ় করার



প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়, যেমন কলাগাছ থেকে কলাবউ। যে কলাগাছের আপনি কলা খান সেই কলাগাছকে বউ বানিয়ে, আপনাকে গণেশ বানিয়ে দেওয়া হলো। আপনার ব্যবহারিক জীবনের বস্তুকে ব্যবহারিক থেকে সরিয়ে এনে এক আলাদা অস্তিত্ব দেওয়া হলো। এরকম আরো উদাহরণ আছে। যেমন ঘট, আপনার সংসারের মঙ্গলঘটে আপনার সমস্ত অস্তিত্বকে আটকে দেওয়া হলো। এটা মানুষের কাব্যিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করার এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া।
         নাটকে এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা যায় কিন্তু লোকাচারের মতো করে নয়। কারণ নাটক লোকাচারের মতো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সরাসরি প্রসারণ নয়। নাটক মঞ্চে করতে হয়, নাটকে অভিনেতা, দর্শক অবস্থান সুনির্দিষ্ট। তাই দর্শক-বস্তু সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব এবং বস্তুগত ভাব থাকবে। নাটকে কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাসের দ্বারা দর্শক পূর্ব পরিচালিত  থাকে না, বিশ্বাস তৈরি করে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে নাটকে  বস্তু ব্যবহারে, বস্তু পদার্থের রূপের পরিবর্তন, বিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্রে নতুনতর অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করতে পারে— যা বস্তুনির্ভর নয় নাট্যনির্ভর। শানু রায়চৌধুরী নাটকে কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর বস্তুপদার্থের রূপের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চারের প্রয়াস ঘটেছিল।
শানুর রান্নাঘরে কিছুক্ষণ
       শানুর রান্নাঘর, হঠাৎ মঞ্চে মুখ ঢোকানো একটা কাপুড়ে ঘর। দেখলে মনে হয় উপর থেকে ঝোলানো। ঘরের তিনদিক ঢাকা দেওয়ালে আর চতুর্থ অংশ উইংয়ে ঢোকানো। ঘরের তিনটে দেওয়াল তিন রকমের। সামনের বড়ো দেওয়াল হলুদ জালের তৈরি, তার উপর আবছা নীল রেখায় দুটো পাহাড়ের চূড়া ভেসে আছে। পাশের দেয়াল প্লাস্টিকের। শ্যাওলাটে হলুদ রং।  গায়ে হাজার ক্ষত বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। উপরের কোনায় ছোট্ট গোল এগজস্ট পাখার জায়গা, পাখা নেই শুধু গোল, তার চারিপাশে রক্তের মতো লাল রং। তৃতীয় দেওয়ালটা কাপড়ের, বেঁকে ঝুলছে। তার গায়ে ছবি আঁকা, চোখবিহীন পাখাওয়ালা এক মেয়ের ছবি আবছা দেওয়ালে ভাসছে। দেওয়াল বাঁকা বলে মনে হয় যে মেয়েটা উড়ে যাবে। কিন্তু চারকোণে দেওয়াল দড়ি দিয়ে বাঁধা। প্রত্যেকটি দেওয়ালই চারকোনা কিন্তু জ্যামিতিক নিয়ম না মেনে প্রত্যেকটিই যেন এক অংশে উচ্ছঙ্খল, ভেঙে বেরিয়ে যাবে। দেওয়ালের কোনো অংশই একে অপরকে ছোঁয় না, কিন্তু এমনভাবে সাজানো যেন মনে হয় খুব কাছের। শুধু এক অংশে জোড়া যেখানে ঘর দম আটকানো লাগে। ঘরে বা কোণের পিছনের দিকে একটা নীল দরজা তাতে হলুদ রেখাতে অসংখ্য দরজা আঁকা যাদের সবার একটাই কড়া। দরজা বন্ধ। দরজা দেওয়াল থেকে একটু এগিয়ে। শানুর রান্নাঘরে ঢুকলে প্রথমটা খোলা মনে হয় কিন্তু তারপর বেরনোর পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবল শানুর সাথে ছাড়া।
          শানুর সাথে দেওয়াল কথা বলে। শানু যখন অসহায় ভাবে দেওয়ালকে আঁকড়ে ধরে, দেওয়াল আশ্রয় দেয়। শানুর সাথে দেওয়ালও কুঁকড়ে ওঠে। দুমড়ে যায়, দম বন্ধ হওয়া শানুর মতো ফেপে ওঠে আবার মুষড়ে যায়। দেওয়াল শানুর মুখোশ হয়ে যায়, আবার শানু যখন রাগে ফোসে, প্লাস্টিকের দেওয়াল জুলে ওঠে রক্তবর্ণে। বৃষ্টির - মতো হাজার ক্ষত আগুনের শিখা হয়ে যায়। আর ছবি আঁকা দেওয়াল শানুর মনকে আশ্রয় দেয়। আশা ভালোবাসার সাথি, অজানা ভবিষ্যতের প্রতিবিম্ব যার ফাঁকে শানু লুকোচুরি খেলে।
          শানুর নীল দরজাও কথা বলে। শানু কয়েকবার বেরিয়ে আসে অতীতের ছায়া হয়ে ঘরের বাইরে, কিন্তু দরজা খোলে না।  শুধু কয়েকবার নীল্ হয়ে জ্বলে ওঠে। দরজার গায়ে মিশে থাকে দরজার ছায়া। নিঃশব্দে বলে শানুর বন্ধ জীবনের কথা।
          শানুর রান্নাঘরের অন্য আসবাবও যেন শানুর সাথে বোনা। ঘরের খাবার টেবিল, চেয়ার ঢাকনায় মোড়া। ধোয়াটে নীল রঙের উপর লাল ডোরা কাটা। দেখলে মনে হয় নীল চেয়ার, লাল দড়িতে বাধা। তাতে শানু যখন বসে, তার অতীতের বহু স্মৃতি আউড়ে যায়, প্রথমে মন ভেসে যাবে সেই কথায় তারপর হঠাৎই মনে হয় সে সবই তো বাধা ওই চেয়ারে। দেওয়ালের মতো সব আসবাবই বাধা উৰ্দ্ধমুখে, বেরিয়ে পড়ার শেষ মূহুর্তে। এমনকী ঘরের ফ্রিজটারও একই অবস্থা। মাথা বেঁকিয়ে উঠছে উপরে। শেষ মুহুর্তে শানু যখন পোখরা না যাওয়ার বেদনাকে ভুলতে চায় এক ঢোক পেপসিতে, বসে পড়ে খোলা ফ্রিজের সামনে তখন পিছনের ফ্রিজ হয়ে যায় সূর্যের আলোয় ভরা বরফে ঢাকা দুরের পাহাড়।
উপসংহারের খোঁজে
         নান্দীকারের শানু রায়চৌধুরী নাটকে দৃশ্যপট গড়তে গিয়ে অনেক গুলো প্রক্রিয়ার সম্ভাবনার যৌক্তিকতাকে নতুন করে অনুভব করি।
          প্রাথমিকভাবে আমি ছবি আঁকিয়ে । ছবি আঁকতে গিয়ে আমার প্রায়শই একটা কথা মনে হয় যে ছবির সাথে সাথে কীসের উপর ছবিকে দেখছি। (ক্যানভাস, কাগজ, দেওয়াল না কি অন্য কোনো জমি ) তার একটা বড়ো ভূমিকা আছে। আর এই তলকে যদি ছবির বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায় তাহলে যে কোনো ছবি নতুন মাত্রা পায়। যখন কোনো ছবি কাগজ বা ক্যানভাসে আঁকা হয়, তখন কাগজ বা ক্যানভাস ছবিকে একটা ফ্রেম দেয়, একটা নির্দিষ্ট ভূমি তার আর কোনো কাজ থাকে না। কিন্তু যে মুহুর্তে ছবির জমি একটা দরজা বা একটা পিচের ড্রাম বা এরকম অন্য কোনো জিনিস হয় যার নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে বা অস্তিত্ব আছে তখন তার উপর আঁকা ছবি শুধু নিজের কথা বলে না, জিনিসগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে নেয় ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে, তখন পিচের ড্রামকেও কালাচাঁদ মনে হবে।
            আসলে মূল প্রশ্নটা হলো শিল্পী কীভাবে communicate করতে চান। শিল্পী বাস্তবে যা দেখেন তারই প্রতিবিম্ব দেখাতে চান, নাকি চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুনতর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করতে চান। যেখানে অভিজ্ঞতার সূত্র হয়তো বাস্তবজীবন কিন্তু অস্তিত্ব নিজস্ব (a reality in itself), আমি মনে করি শিল্পের যদি কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব না থাকে সে যদি তার নিজস্ব জমি (space) না তৈরি করতে পারে তাহলে সে সার্থকতা লাভ করে না। কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব তখনই তাড়িত হয় যখন অপর এক অস্তিত্বের সংঘাতে সে আসে। আর যে কোনো শিল্প এই সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে এক মানসিক প্রক্রিয়ার উদ্রেক করে। বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় এই প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা অসীম। নাটকেই দর্শকের সবচেয়ে বেশি অস্তিত্বের সংঘাত ঘটে। সে ক্ষেত্রে মঞ্চদৃশ্য ভীষণ বড়ো ভূমিকা নেয়, বিশেষ করে মঞ্চে ব্যবহৃত বস্তু পদার্থ। 
শানু রায়চৌধুরী নাটকে  আমি বুঝতে পারলাম কীভাবে দেওয়ালের বস্তু পদার্থ  জাল, প্লাস্টিক আর কাপড় হয়ে যাওয়ায় শানুর চরিত্রের অস্তিত্বও বদলে যায়। কীভাবে তারা শানুর অস্তিত্বে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেকটা বস্তুপদার্থ কীভাবে নাটকীয় হয়ে যায়।

          নাটকে মঞ্চ যদি কেবল নাটকীয় পরিবেশ হয়েই থাকে তাহলে নাটকের দৃশ্য বর্ণনা ছাড়া মঞ্চের কোনো কাজ নেই। সেখানে দেওয়ালই হোক, দরজাই হোক আর আসবাব পত্রই হোক, তাদের বাস্তব রূপটাই কাম্য - ঘুন ধরা দরজা আর শিকড়ে ফাটা দেওয়াল। বাস্তব অভিজ্ঞতার সুনিপুণ নকলই শ্রেয়। কিন্তু মঞ্চদৃশ্যকে নাটকীয় অস্তিত্বের স্বার্থে একত্রিকরণ করতে গেলে দেওয়ালের রূপ বদলালেই চলবে না চরিত্রও বদলাতে হবে, তবে না সে অভিনয়ে অংশগ্রহণ করবে। অভিনেতাকে feed back দেবে। দেওয়াল  যদি অভিনেতার গতি প্রকৃতির সাথে দুমড়ে যায় মুচড়ে যায়, জ্বলে ওঠে, দর্শকের ভাবনা স্রোতেও নাড়া লাগে, বস্তু অভিজ্ঞতা বদলে যায়। জন্ম নেয় একধরনের কাব্যিক প্রক্রিয়ার যার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে নয় অভিজ্ঞতাতেই সার্থক ।

          নগরকীর্তন নাটকের মঞ্চে একটা যক্ষীর মূর্তি আছে যেটা হোটেলের পরিবেশে বিশেষভাবে প্রয়োজন। আবার মন্দিরেও প্রয়োজন। কিন্তু ওই মূর্তি তো শহরের রাস্তায় রাখলে চলবে না অতএব এই মূর্তি প্লাস্টার ফাইবার বা কাগজের করা যাবে না। এমন কোনো জিনিস দরকার যা এই তিন পরিবেশের সঙ্গে মানানসই আর নাটকের মূল ভাবনার সঙ্গে যায়, তাই মূর্তি বানানো হলো স্যানিটারি পাইপে, যার মাথা নেই। আকারে যক্ষী মূর্তি হলেও বস্তুত এ পাইপ।  শুধু তা নয় পাইপ লাগানোর ফলে মূর্তি অভিজ্ঞতায় একটা অস্বাভাবিকতা এসে যায় যা যান্ত্রিক এবং ফাঁপা। বস্তুর ব্যবহারের এই বিবিধতা যদি নগরকীর্তন নাটকের অন্য মঞ্চঅঙ্গে ব্যবহার করা যেত তাহলে বস্তুপদার্থের চরিত্র পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাটকীয় মুহুর্তকে আরো সমৃদ্ধ করা যেত।
               স্বাভাবিকভাবে আমাদের যে বস্তু অভিজ্ঞতা তাকে যদি অন্য মাত্রায়, অন্য পরিবেশে, অন্য প্রসঙ্গে নাটকে ব্যবহার করা যায়। তাহলে নাটকীয় অভিজ্ঞতাই যে শুধু ভিন্নতর হয় তা নয় বাস্তব জীবনে বস্তু সম্পর্কও বদলে যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment