সরসিজ সেনগুপ্তের নতুন লেখা
ব্যায়াম-বীর
এখন চারদিকে 6 pack, 8 pack-এর ভিড়।আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় পাড়ায় এতো
দৈনিক এক ঘন্টা ।সময় রেখেছিলাম ভোরের দিকে যাতে এক ঢিলে সকালে ওঠা আর ব্যায়াম দুটোই হয় ।ঘুম ঘুম চোখে সর্ট্স আর টি-সার্ট পরে একটা তোয়ালে হাতে যেতাম আখড়ায় ।ব্যাপারটা যে খুব আরামদায়ক ছিল তা নয়- তবে কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না, আখড়ার ছেলেদের ব্যায়ামপুষ্ট উজ্জ্বল স্বাস্থ্য আর মনোবল দেখে নিজেকে অনুপ্রাণিত করতাম । শরীরই ছিল ওদের কাছে ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা সব কিছূ । কেউ সর্টস্ কেউ বা ল্যাংট পরে ভোরে এসে আট-দশ পাক দৌড়ে ঝর্ঝরে হয়ে তারপর ফ্রী-হ্যান্ড ব্যায়াম করে ওজন তুলতেন, এসবের পর গ্লানিবোধ করলে ঘন্টাখানেক ম্যাসাজ নয়তো সাঁতার । বলাই বাহুল্য এর যেকোনো একটা ওদের অর্ধেকের কম করেই আমার জিভ বেরিয়ে যেত। ম্যাসাজের নাম শুনে প্রথমে খানিক উৎসাহবোধ করেছিলাম কিন্তু পরে তার নমুনা দেখে ভরসা পাইনি । সত্যিকথা বলতে প্রথমদিকে আখড়ায় আমার তেমন কদর ছিল না । অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রে নিশ্চয়ই জানেন- প্রতিটা আখড়ার একটা নিজস্ব hierarchy থাকে যেটা নির্ধারিত হয় ওজন তোলার ক্ষমতা বা শারীরিক পটুতার ওপর নির্ভর করে- যার কোনোটাই আমার বিশেষ ছিল না । আমার ব্যায়ামবীর বন্ধুরা যেসব ওজন একহাতে তুলতেন আমি দুহাতেও তা তুলতে পারিনি কখনো, স্বভাবতই আখড়ায় তুই-তোকারির বেশি আমার কপালে কিছু জুটতো না । সকলেই প্রায় হুকুম চালাতেন- এটা নিয়ে আয়, ওটা দিয়ে যা ইত্যাদি । আমিও নির্বিবাদে সেসব তামিল করতাম কারণ ওদের প্রতি কেমন যেন একটা প্রগাঢ় শ্রধা হতো আমার- ফোঁস্ ফোঁস্ ডন্ মারতে মারতে ভাবতাম, কোনোদিনও কি পারবো অরকম বাইসেপ্স বা ট্রাইসেপ্স বানাতে? ছোটো খোকা আশ্বাস দিতো, বলতো, সময়ে সব হয়- চিন্তার কোনো কারণ নেই । ব্যায়ামাগারের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা বলতেন- মাস্লটা বাইরের লোক-দেখানো ব্যাপার, আসল হলো মন!
সেটা কম্পিটিটিভ পরীক্ষার মরশুম- ভোরবেলা প্যারালাল বারে ঝুলতে ঝুলতে শুনলুম কী নিয়ে একটা ভারি বচসা হচ্ছে । ঠাওর করে বুঝলাম আমার বন্ধুরা ব্যায়ামের ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন পত্রের grammar অংশ রপ্ত করছেন । বচসাটা preposition-কেন্দ্রিক! ভাগ্যক্রমে আমার সেটা জানা ছিল, ঝুলতে ঝুলতেই গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ‘at নয়, ওটা in হবে।’- চাকা ঘুরল এবার । অদ্ভুত সম্মানের পাত্র হয়ে গেলাম সকলের কাছে! ব্যায়াম করতে করতে ওদের ব্যাকরণের জিগীষা মেটানোর ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠছিল দারূণ বন্ধুত্ব ।ওরাও চিন্তিত আমার শরীর, স্বাস্থ্য, ভবিষ্যত নিয়ে। বিশেষতঃ পুজো আসার আগে আমায় ‘হাত করতে’ না দেখে খুবই মনক্ষূণ্ন হয়েছিল ওরা! এ ব্যাপারটাও একটু খুলে বলা দরকার: প্রত্যেক আখড়াতেই বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে এক একটা বিশেষ ধরণের ব্যায়ামের ওপর ঝোঁক পড়ে – এভাবে একটা অলিখিত নিয়মও তৈরি হয়ে যায় । এসব রূটিনের রদ্বদল যে হয় না তা নয়, তবে শ্রাবণ মাসের পর থেকে পুজো অবধি ‘হাত করা’-টা ইউনিভার্সাল । ‘হাত করা’ মানে হাতের ব্যায়াম । তারমধ্যে বারবেল, ডাম্বেল তোলা ছাড়াও মূলত থাকে লাটাই করা ।- একটা ছোট্ট কাঠের লাঠির মাঝামাঝি জায়গায়ে দড়িতে একটা ভারী ওজন ঝোলানো থাকে, সামনে দু হাত বাড়িয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে সেটাকে বারবার ওপরে তুলতে হয় আর ছাড়তে হয় । এতে হাতের মাস্ল খুব দ্রুত চওড়া হয় । পুজোর আগে সবাই তখন ব্যস্ত লাটাই করায়, আমাকেও ওরা বললো- লাটাই কর্ । কেন-? দ্যাখো কান্ড! পুজোয় কদিন আস্তিন গুঁটিয়ে না ঘুরলে মেয়েরা যে ফিরেও তাকাবে না তোর দিকে !
অনেকদিন হলো আখড়ায় যাওয়া হয় না আর। রাত-বিরেতে দক্ষিণ কলকাতার তথাকথিত নানান কুখ্যাত জায়গা দিয়ে যখন একলা হেঁটে যাই, আখড়ার বন্ধুদের নাম মনে করে ভরসা পাই । ওরাও নিশ্চয়ই আমাকে ভোলেনি । আমি বিপদে পড়লে, জানি আমার ব্যায়ামবীর স্যাঙাতরা আমাকে বাঁচাবে ঠিকই ।
No comments:
Post a Comment