মিনুর মা
সরসিজ সেনগুপ্ত
সরসিজ সেনগুপ্ত
কাঁটায় কাঁটায় সাতটার সময় চলে আসত মিনুর মা । না, ভুল বললাম : ঠিকে কাজের লোকেরা আবার ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আসে নাকি ? নিশ্চয়ই আমার মিনুর-মাও দেরি করত, এখন ভালো মনে নেই । মিনুর-মাকে দেখতে ছিল অবিকল সুরেন কর -বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় –অবন ঠাকুর নন্দলালের অাঁকা দেশী স্ত্রী চরিত্রের মতো। সবুজ ডুরে শাড়িতে জড়ানো কালো ছিপছিপে চেহারা, মাথায় জটপাকানো-পরিপাটি তেলতেলে লালচে চুল । টানা টানা কালো চোখ। শিরা বার করা সরু হাতে আলগা লাল শাঁখাটাকে কেন জানিনা বেমানান লাগত খুব । অথচ ওটার প্রতি মিনুর মার যত্নের অন্ত ছিলনা, ঘর মোছার সময় কখনো কখনো হাত থেকে খুলে আমাদের সোফার ওপর রেখেও দিত সেটা । কতদিন খাটে বসে মিনুর মার মোছা ঘরে গোল টানা ভিজে ন্যাতার দাগ শুকোতে দেখতে দেখতে ভেবেছি হয়তো ওটা নিতে ভুলে যাবে মিনুর-মা, কখনো ভোলেনি ! এছাড়া দামি জিনিস বলতে মিনুর মার সঙ্গে থাকত একটা ছেঁড়া খবরের কাগজের ঠোঙা— তাতে হয় থাকত ছাই অথবা হরিণঘাটার দুধের বোতলের লালশাদা ডোরাকাটা, সোনালি অ্যালুমিনিয়ামের ছিপি । বাড়িতে ঢুকেই সদর দরজার পাশে এক কোণায় ওগুলো রেখে দিত মিনুর মা। এ জিনিসগুলো অথবা নিজের ফাটল ধরা চটিটার ওপর বোধহয় অতটা টান ছিল না, নিয়ে যেতে ভুলেও যেত মাঝে মাঝে । আর দামি জিনিস বলতে ছিল নিখিল, মিনুর মার কাছে সেও একটা জিনিসই বটে ! অন্য জিনিসগুলোর মতো নিখিলকে ঘরের দোরগোড়ায় বসিয়ে দিয়ে চলে যেত মিনুর মা । আমি আর নিখিল তখন সমবয়সীই হব । বড় বড় চোখে নিখিল আমাকে দেখত, আমিও দেখতাম ওকে ! ও মাটিতে ঘরের বাইরে সিড়ির ওপর আর আমি আধশোয়া হালকা সবুজ চাদর পাতা নরম বিছানায় । ওদিকে কানে আসত রান্নাঘরে ঝনঝন বাসন মাজার শব্দ । ছাইয়ের ভেতরের পাথর লেগে কড়া ঘষার কর্কশ শব্দে চমকে যেতাম, তারপর অনেকক্ষণ ধরে শান বাঁধানো মেঝেয় জল ঢালা আর ঝাঁটা বুলোনোর শব্দ।
একটা সময় মিনুর মা-ই পৌঁছে দিত ইস্কুলে। ঠিক যেভাবে টিউকলে জল আনতে যেত কোমরে কলসি গুজে, সেভাবে আমাকেও কোমরে গুজে ফেলত মিনুর মা। কোমর থেকে পিছলে গিয়ে আমি শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরতাম মিনুর মার গলা । কাঁধ থেকে চাবি বাঁধা অাঁচলটা মাটিতে খসে শব্দ তুলত ঠং ।
মিনুর মার শাড়ির অাঁচলে অজস্র গেরো বাঁধা থাকত - কেন জানিনা । তার একটায় খুচরো পয়সা থাকত জানি, অন্যগুলোয় ? ঐভাবে কোলে চড়ে ইস্কুল যাওয়ার পথে সে রহস্যই ভেদ করার চেষ্টা করতাম। অাঁচলে বাঁধা গিঁটগুলো খোলা সহজ ছিল না। কোনোদিন হয়তো অনেক কসরৎ করে ছোট ছোট আঙুলে খুুলেও ফেলতাম একটা, দু নম্বরটা খোলার আগেই মিনুর মা আমায় পিঠ বদল করে ফেলত ! কিংবা ইস্কুল কাছে এসে যাওয়ায় আমাকে কোল থেকে নামিয়ে ফেলত - কোলে চড়ে ইস্কুলে গেলে কিণ্ডারগার্ডেন স্কুলের টিচার বড্ড বকাবকি করে। আবার খুদে পায়ে হাঁটাতেও সময় লাগে বেশি, অত অবসর মিনুর মার কোথায় ? তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর গিয়েই আমায় ট্যাঁকে গুঁজে নিত মিনুর মা আর ইস্কুল এসে যাওয়ার একটু আগে নামিয়েও দিত । সকালের ঐ কুড়ি মিনিটের কোলে চড়া মনিংওয়াকে কত লোকের সঙ্গে আলাপ হতো - দু দন্ড পরে পরেই দাঁড়িয়ে পড়ত মিনুর মা । মিনুর মার মতো আরো কেউ তারও কাঁধ অাঁকড়ে আমার সমবয়সী কোনো ছেলে বা মেয়ে — দ্রুত খানিকক্ষণ আলাপ সেরে নিত ওরা । দুচার জনের সঙ্গে দেখা হতো যারা অপেক্ষাকৃত বয়সে বড়, শাদা থান পরা, কাঁচা-পাকা চুল - চশমাও থাকত অনেকের চোখে । এঁরা ছিলেন পাড়ার কাজের লোকদের গার্জেন স্থানীয়, মিনুর মা খুব বেশি ঘেঁষতো না ওদের দিকে । এর মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল অসোয়াস্তিকর - চলার পথে হঠাৎ থেমে পড়ে সশব্দে নাক ঝাড়তো মিনুর মা । তারপর দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতটা মুছে নিত পাশের ল্যাম্পপোস্ট অথবা শাড়ির খুঁটে । যেদিন শাড়ির খুঁটে মুছত সেদিন আর অাঁচলের গিঁট খোলার চেষ্টা করতাম না।গলা থেকে জড়ানো হাতটা শিথিল হয়ে আসত বারবার।
ছুটির দিন মিনুর মার কোলে চেপে বেড়াতে বেরোতাম একটু বেলার দিকে । সেদিন মিনুর মার এক কোলে আমি অন্যদিকে কলসি । পেছন পেছন পরনের ঢিলে ইজেরটা এক হাতে গোঁটাতে গোঁটাতে আসত নিখিল পথে পড়ে থাকা রঙিন সিগারেটের প্যাকেট, রাংতা, কাঁচের টুকরো যা পেত পকেটে পুরত ও । এই একটা ব্যাপারে ওর ওপর হিংসে হতো খুব । ঐ বয়সেই ও আমার থেকে কোথায় যেন অনেক বেশি স্বাধীন ছিল ।
নিখিলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল খুব। মাঝে মাঝে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় মাখন কাটার ছুরি নিয়ে ওকে ভয় দেখাতাম, হেঁড়ে গলায় ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠত নিখিল, বাথরুম থেকে ধমক দিত বিরক্ত মিনুর মা।
তিন রকম শব্দ ছিল কাপড় কাচার । ধপধপ-দুমদুম-এটা ভারী কাপড় কাচার । চটাস চটাস—এটা ছোট কাপড় কাচার আর ছপ্ ছপ্ -এটা জলকাচার । খুলে রাখা কল থেকে বালতি উপচে জল গড়িয়ে নালিতে যেত, আমি আর নিখিল তখন ব্যস্ত উঠোনের ধুলো বালি ঘাঁটায় । এরমধ্যে একসময়ে হয়তো মিনুর মা নিজের জলখাবারের দুটো বাসি হাত রুটির একটা গুজে দিত নিখিলের হাতে। নিখিল বসে বসে রুটিটা চিবোত। ওর শাদা দাঁতে হলুদ মানচিত্র, ফাটা গোড়ালিতে হিজিবিজি কালো নদীর শাখা প্রশাখা, অজস্র ব-দ্বীপ। শুকনো রুটি আমার ভালো লাগে না, অত ভালোবেসে ও খায় কী করে ?
মিনুর মা একটা বড় কাঁচের গেলাসে চায়ের মধ্যে হাতের রুটিটা লম্বা পাকিয়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খেত। মা চা দেওয়ার পর আরো এক চামচ বাড়তি চিনি মিনুর মা চায়ে গুলে নিত । অন্ধকার রান্নাঘরে দেয়ালে - ঠেসান দিয়ে মেঝেতে বসে হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে মিনুর মা চা খেত । ধীরে সুস্থে বাঁ হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে মাথার চুলগুলো আলাদা করতে করতে মিনুর মা চা খেত। পায়ের কাছ দিয়ে বড় কালো পিঁপড়েগুলো সরসর করে হেঁটে যেত। আমি হাঁ করে দেখতাম। দেখতাম মিনুর মা কীভাবে রুটি চিবুচ্ছে, কীভাবে চায়ে চুমুক দিচ্ছে—কেন জানি না ওটি খুব দর্শনীয় ঠেকত তখন ।
নিখিলকে আমার খেলনাগুলো দিয়ে খেলতে দিলেও ও সাহস পেত না, ইতস্তত করত। তবে ওর কুড়োনো সম্পদগলোয় আমি ভাগ বসাতাম সহজেই। কখনো কখনো ও দিতে না চাইলে ওর মাকে নালিশ করে আদায় করতাম হোমিওপ্যাথি ওষুধের ছিপি অথবা ওয়াইল্ড উডবার্ন সিগারেটের সবুজ লাল প্যাকেট। এসময়েই একদিন বিড়ি খেয়েছিলাম আমরা দুজন । ইচ্ছেটা মনের ভেতর ছিল অনেকদিনই, সুযোগ পাচ্ছিলাম না। জানা গেল ওরকম একটা বাসনা নিখিলেরও আছে । মিনুর মা নিয়ে বেরিয়েছিল আমাদের দুজনকে । একটু অন্যমনস্ক হতেই আধপোড়া জ্বলন্ত একটা বিড়ি তুলে টান দিয়েছিলাম। সেদিন শাসনের কোনো তারতম্য হয়নি। দুজনেরই কান ধরে চড় কষিয়েছিল মিনুর মা। তারপর নানান উপদেশে জর্জরিত করতে করতে হাজির করেছিল মার সামনে ।
একটা কথা এখনো ভাবলে অবাক লাগে। মিনুর মা আদতে নিখিলের মা হলেও, নিখিলকে কখনো মার আদর খেতে দেখিনি। বরঞ্চ মিনুর মার আদর সোহাগের ভাগীদার দৃশ্যতঃ ছিলাম আমিই। আশ্চর্য এ নিয়ে নিখিল কোনোদিন কোনো প্রতিবাদও তো করেনি। ওরই মায়ের কোলে চড়ে যখন আমি ঘুরতাম, বেড়াতাম—পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে আসত নিখিল । কী একটা অদ্ভুত নিয়মে ঐ বয়সেই ও জেনে গিয়েছিল ওর মার কোলটা নির্ধারিত আমার জন্য !
নিখিলের কি কখনো মার কোলে চড়তে ইচ্ছে করেনি ?
No comments:
Post a Comment