শৈলদি
সরসিজ সেনগুপ্ত
শৈলদির গায়ে ছিল রান্নাঘরের মশলাপাতি, নারকেল তেল, বার সাবান আর নস্যি-মেশানো
খুব নরম একটা গন্ধ। গন্ধটা এত ভালো মনে আছে তার কারণ বহুদিন শৈলদির কোলে বসে ঐ গন্ধ শুকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও টের পাইনি ! শৈলদির শাদা থানে জায়গায় জায়গায় লেগে থাকত ছোপছোপ হলুদ দাগ, অবশ্য আরেকটা থান ছিল শৈলদির—সেটা বাইরে পরার জন্য। সেটা এতটাই শাদা ছিল মাঝে মাঝে যখন কেচে উঠোনে দড়ির ওপর শৈলদি কাপড়টা শুকোতে দিত, ঘরের ভেতরটা হঠাৎ এক পোঁচ বাড়তি আলোয় ভরে যেত । শৈলদির আসল নাম ছিল মহারানী ।
সেকথা জেনেছি অনেক পরে । কলকাতায় কাজে আসার পর কোনো বাড়ির বৌ-এর নাম ও মহারানী হওয়ায়, শৈলদির-মহারানী নাম পাল্টে হলো শৈল । শৈলদির বাড়ি জয়নগরে, তিনকুলে এক ভাই ছাড়া শৈলদির আর কেউ ছিল বলে জানা নেই। থাকলেও অন্তত আমার তাতে কিছু এসে যায় না কারণ শৈলদি ছিল আমার, একেবারে আমার — আর কারো নয়। মাঝে মাঝে অবিশ্যি অনন্তদা আসত। একটা ঘিয়ে রঙের হাফহাতা পাঞ্জাবি আর আধময়লা ধুতি পরে । কালো ছাতাধরা পামশুটা দোরগোড়ায় খুলে শৈলদির তক্তপোশে পা গুটিয়ে বসতো অনন্তদা । তারপর গায়ের জামাটা খুলে একপাশে আলগোছে সরিয়ে রাখত। শৈলদি একটা বড় কাসার গেলাসে করে এক গেলাস জল আর দুটো লাল বাতাসা এনে একটা গোলাপি-নীল রঙে-ছোপানো হাতপাখা নেড়ে নেড়ে হাওয়া করত অনন্তদাকে । বাতাসা দুটো টক করে মুখে ফেলে গেলাসটা উচু করে ধরে একেবারে গোটা জলটা নিঃশেষ করে দিত অনন্তদা । দরজার কোণ থেকে গোপন ঈর্ষা আর কৌতূহল ভরা চোখে আমি এসব দেখতাম ! অনন্তদা সেই খুলে রাখা শার্টের বুক পকেট থেকে একটা নোট বইয়ের মতো টিপিন কৌটোটা খুলে তার ভেতর থেকে লালচে ন্যাকড়া জড়ানো একটা পান বার করে মুখে ফেলত তারপর জামার অন্য পকেট থেকে এক বাণ্ডিল বিড়ি বার করে ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে খনিক কাশত । সে সময় ঘরের পাশ দিয়ে বাড়ির বড়রা কেউ গেলে হয়তো বলত : “কি হলো অনন্তর কাশি হলো নাকি ? অনন্তদা তাড়াতাড়ি আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে, ‘ও কিছু নয়, ও কিছু নয়’ বলতে বলতে ডান হাত দিয়ে প্রাণপণে বিড়ির গন্ধ তাড়াতো ! আবার সব চুপচাপ হয়ে যেত । সঙ্গের অাধ ময়লা থলির ভেতর থেকে অনন্তদা যেন কী সব বার করে শৈলদিকে দিত, শৈলদিও নিজের নীল-সবুজ জংলা নকশা কাটা ছোট্ট টিনের তোরঙ্গের ভেতর থেকে কী সব বার করে অনন্তদার হাতে গুঁজে দিত। ভারী লোভ হতো জিনিসটা দেখার কিন্তু কোনোদিনও দেখতে পাইনি ! মাঝে মাঝে ফিস ফিস করে দুই ভাই-বোনে নানান কথা বলত, সেগুলো শুনতে না পেয়ে গুটি গুটি পায়ে এগোতে এগোতে ঘরের ভেতর ঢুকতেই ওরা একেবারে চুপ ! শৈলদি বলল, কিরে ঘুমোসনি এখনো ? কী করে ঘুমোই ? শৈলদির কোল ছাড়া কি ঘুম হয় আমার ! নিজের তেলচিটে বালিশটা যত্ন করে অনন্তদাকে পেতে দিয়ে শৈলদি তখন আমাকে নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে আসত । বিকেলের দিকে ও ঘরে গিয়ে দেখতাম অনন্তদা তক্তপোশের ওপর ঘুমোচ্ছে, আর তার তলায় মেঝেতে কুণ্ডলী পাকিয়ে অাঁচল পেতে শৈলদি শুয়ে আছে। নানারকম সুরে নাক ডাকত অনন্তদা। হাফহাতা জানলা কাটা শাদা গেঞ্জির ভেতর দিয়ে বাদামি রোমশ শরীরটা আস্তে আস্তে ওঠা নামা করত। ভনভন মাছিগুলো মুখের ওপর বসলে নাক ডাকার শব্দ যেত কমে ।
পাড়ায় বেরিয়ে কাজের লোকদের যে দলটার সঙ্গে মিনুর-মা বেশি মিশত না, শৈলদির আবার ভাব ছিল তাদের সঙ্গে। তখন এই ছোট ছোট দলগুলোর কোনটা কীসের ভিত্তিতে হয় না বুঝলেও, বেশ বুঝতাম একটা অলিখিত নিয়ম আছে এর পেছনে। আর তা ছিলও—এপার বাংলা ওপার বাংলা, সধবা-বিধবা, অপেক্ষাকৃত নিচু ঘরের কাজের লোক অথবা অবস্থার ফেরে বিপাকে পড়ে কাজ করতে আসা, এসবের ভিত্তিতেই হতো দলগলো । বিকেলে পার্কে অথবা রাস্তার ধরে জমিয়ে মজলিশ বসতো । সকলের সঙ্গেই একটা দুটো ছোটছোট বাবুদের বাড়ির বাচ্চা ছেলে মেয়ে। নিজেদের ঘর হারিয়ে হয়তো ওরা অামাদের ভেতর একটা ঘরের স্বপ্ন দেখেছিল ।
আমরা খেলতাম আমাদের মতো, ওদিকে গল্প চলত। খেলতে খেলতে কখনো ঝাঁপিয়ে পড়তাম শৈলদির কোলে - কথাবলার ফাঁকে ফাঁকে শৈলদি তখন জামার খুলে যাওয়া বোতামটা লাগিয়ে, ঠিক করে দিত মাথার এলোমেলো চুলগুলো। কখনোসখনো ঝগড়া হতো এসব সময় । কানে ভেসে আসা সেই ঝগড়ার শব্দে আমাদের ভোকাবুলারি আয়তনে বেড়ে উঠত ! শৈলদির বলা গল্পের থেকেও ভালো সেসব ঝগড়া।রূপকথার ভেতর রূপকথা, আমাদের ভীষণ অপরিচিত অজানা এক বাস্তব । আমরা যে চৌহদ্দিতে বড় হই তার বাইরে হাতছানি দেয়। ঝগড়ার পর গজগজ করতে করতে আবার যে যার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দিত বাড়ির দিকে।
গম কলের ছোট্ট গ্যারেজ ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে বুক কেঁপে ওঠে, ওর চেয়ে আশ্চর্য জিনিস আর কী হতে পারে ? কুলুঙ্গির নাদা-পেটা লাল গণেশ ঠাকুর মায় তার নেংটি ইদুঁরের মাথার ওপর জ্বলা সবুজ ছোট্ট আলোটা কাঁপিয়ে মেসিন চালু হতো। ওপর দিয়ে ঢেলে দেওয়া সোনালি গমগুলো শাদা মিহি গুঁড়োয় জমা হতো সামনে লাগানো থলিতে । ঐ গমগুলোই দোকানে যাওয়ার আগে, বাড়িতে শৈলদি কুলোয় ঝাড়ত। ঝপ্-ঝপ্-ঝপ্-ঝপ্-ঠক্ , ঝপ্-ঝপ্-ঝপ্-ঝপ্-ঠক্ শূন্যে উঠে ছড়িয়ে যাওয়া হলুদ বৃষ্টি আবার জড়ো হতো কুলোর ওপর ! গমকলের সামনের থলি পালটানোর সময় লালাজি যখন দ্রুত কাপড়ের মুখটা চেপে ধরে, ময়ুরপঙ্খী নায়ের পাল হয়ে হাওয়ায় ফুলে ওঠে সেটা । সদ্য ভাঙানো গমের আটার গভীরে হাত ঢোকালে শরীর শিরশির করে ওঠে এক অজানা গরমে । সেই আটা চেলে রুটি করার সময় একটা ছোট্ট আটার গুলি বহু কষ্টে ম্যানেজ হয় শৈলদির কাছ থেকে। কখনো গোল মানুষের মুখ, কখনো সাপের মতো লম্বা ক্ষুদে ভাস্করদের পক্ষে সেটাই সহজতম | পাছে হারিয়ে যায় সেটা লুকিয়ে রাখতাম কোনো দুরূহ কোণায়, ভুলেও যেতাম। রবিবার ঘর ঝাড়ার সময় হারিয়ে যাওয়া চোখের মণি সেই কালচে আঠার শক্ত টুকরোটা ফেলে দিত শৈলদি ।
বৃষ্টি নামে ঝম্ ঝম্৷শৈলদি ঘুম থেকে উঠে দৌড় দেয় শুকনো কাপড় তুলতে।আমিও দৌড়ই । উচুঁ তারে হাত যায় না । কাপড় টানতে গিয়ে লাল, সবুজ, কাঠের ক্লিপ নর্দমায় ছিটকে পড়ে । সেদিন বিকেলে বেরোনো হয়না আর । ফুটো কালো ছাতা হাতে, শক্ত প্লাস্টিকের চটি পায়ে শৈলদি বেরোয় হাতের কাজ সারতে । ‘ও শৈলদি তোমার ছাতা ছেঁড়া কেন?’ ‘ তোর বে হলে বৌকে বলিস নতুন ছাতা কিনে দিতে।’
খালি সপ্তাহে একটা দিন রাত্তিরে রেডিওতে নাটকের সময় কথা বললে শৈলদি বড় রেগে যায় । নাটক ভাঙে কার যেন ভারী গলার ‘সংবাদ-পরিক্রমা’ ঘোষণায়, তারপর গুড়গুড় ঢাকের শব্দ আর মন উদাস করা দূরে টেনে নিয়ে যাওয়া সুর ।
রান্নাঘরে আনাজ কুটে, মশলা বেঁটে সব গুছিয়ে রাঁধতে বসতো শৈলদি ; আমি গিয়ে বসতাম কোলে । গরম তেলে পাঁচফোড়ন পড়ে শাদা ফেনা বেরোত কিংবা চড়চড় শব্দ উঠত সর্ষের, তার মধ্যে গল্প শুরু করত শৈলদি । লঙ্কাফোঁড়নের গন্ধে কাশতে কাশতে শোনা হতো রাজকন্যা রাজপুত্রদের নানান গুণপনা বীরত্বের কাহিনী। তরকারি ফোটার টগবগ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম জড়াতো চোখে ৷ শৈলদি তখন আমি জেগে আছি কিনা দেখার জন্য সদ্য বলা গল্পের থেকে আমায় প্রশ্ন করত । উত্তর দিতে না পারলে বলত - "কে বলেছে কার কথা না বগ বসেছে সারি সারি ! ‘শুইয়ে দি তোকে।’ শোওয়ার ইচ্ছে তখন মোটে নেই কারণ তরকারি নেমে দুধ বসেছে সবে । কড়াইয়ে শাদা ঢেউ তুলে দুধ ফুলে ওঠার মতো মজা আর কিছুতে নেই, আকড়ে ধরতাম শৈলদির হাত । পিঁড়িতে জাঁকিয়ে বসে আবার নতুন গল্প শুরু করত শৈলদি ।রান্না মেটার পর কাপড় ভাঁজ করা । কাপড়ের দুটো কোণ আমার হাতে ধরিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কোনাকুনি টানা হতো খানিকক্ষণ তারপর দুকোণ ধরে ঝাড়া দিলে পটপট করে একটা সুন্দর শব্দ বেরোয় । চোখের নিমেষে মার বড় বড় মাড় দেওয়া কুঁচকানো শাড়িগুলো পরিপাটি চারভাঁজ হয়ে জড়ো হতো চেয়ারের উপর ।
শৈলদি যখন সময় পেত বাইরে বেরিয়ে টাটকা গোবর চোখে পড়লেই হাতে করে তা কাঁচিয়ে-কুড়িয়ে উঠোনে এনে জড়ো করত । তারপর অবসরে তার সঙ্গে পরিমাণ মতো জল, কয়লার গুঁড়ো, ভাতের ফ্যান এসব মিশিয়ে দেওয়া হতো গুল । সে এক ছোট খাট যজ্ঞ । বড় বড় চোখে দাঁড়িয়ে দেখছি ঐ কয়লা আর গোবরের এক এক মুঠো শৈলদির রুক্ষ হাতের মমতার ছোঁয়ায় বর্তুল-গোলাকৃতি ধারণ করছে । রোদের মধ্যে সারি সারি শুকোত কালো কালো গুলের ঢেলা ৷ কখনো কখনো সকলের নজর এড়িয়ে ওগুলো দিয়ে কাকেদের সঙ্গে লড়াই জমতো খুব । শৈলদি ধরে ফেলত কারণ শুকনো গুল তোলার পর মাটিতে ছোট্ট কালো গোল একটা দাগ থেকে যায়। মা আর শৈলদির ঝগড়ার সময়টা ছিল আমার পক্ষে কষ্টের । ঐ বয়সে বলা কঠিন ছিল কাকে বেশি ভালোবসি । মার সঙ্গে ঝগড়া করে যদি চলে যায় শৈলদি ? তাড়াতাড়ি একটা পিড়ি পেতে শৈলদিকে বসিয়ে, নিজে চেপে বসতাম কোলে। শৈলদির বুঝি মনখারাপ হয় ? নিশ্চয়ই হয়৷ নাহলে কেন ঝগড়া করার পর উনুনের গনগনে লাল অাঁচের সামনে স্তব্ধ বসে থাকে চুপচাপ, বহুদূরে মেলে দেওয়া শৈলদির দুচোখের কোণায় টলটলে জল, টগবগে কড়ার রঙিন ঝোল থেকে ওঠা শাদা ধোঁয়া শৈলদির কাঁচাপাকা চুল বেয়ে উঠে শূন্যে মিশে যায় । আর তারপর একদিন চলেও যায় শৈলদি । লাউ গড় গড় বুড়ির মতো শৈলদি চলে যায় শাদা এনামেলের চায়ের বাটির মায়া ছেড়ে । শৈলদি চলে যায় কাঠের তক্তপোশ, মাদুর, কলাইকরা থালা, উঠোনে জড়ো করে রাখা টাটকা গোবরের মায়া ছেড়ে । সেই যে গেল শৈলদি কোথায় গেল আর জানলাম না, তবে মনে মনে জানতাম, অন্তত বিশ্বাস করতাম শৈলদি একদিন ফিরে আসবে ঠিক । ফিরে আসবে আমার কাছে । আর হলোও তাই ।
অনেক অনেকদিন পরে তখন বড় হয়ে কলেজে পড়ি, হঠাৎ এসে হাজির শৈল-বুড়ি ! দরজা খুলে দেখি আমার ছোটবেলাটাকে একটা ছোট্ট পুঁটলি পাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে শৈলদি । আগের সেই ঋজু টান টান দেহ আর নেই, উজ্জ্বলতা নেই চামড়ায়, শণের নুড়ির মতো মাথার চুল ছোট্ট ছোট্ট করে ছাঁটা, তামাটে গায়ের রং আর চশমা-পরা চোখের কোণে কুঁচকানো চামড়া। দেশে বসে আমার জন্য মন খারাপ করতে জয়নগর ঠেঙিয়ে নিজেই এসে হাজির ! কবে মরে যাবে তার আগে আমায় চোখের দেখা দেখতে এসেছে ।
সেবার বেশ কদিন থাকল শৈলদি । বোঝা গেল বাড়ি থেকে ঝগড়া করে বেরিয়েছে, যাওয়ার জায়গাও নেই কোনো। ঠাণ্ডার মধ্যে, শীতের দিন গরম কাপড়ও নেই তেমন। শেষে আমরাই বললাম - তুমি দেশে ফিরে যাও। শৈলদির বোধহয় মনে দুঃখ হলো। যাওয়ার আগে ছলছলে চোখে আমার চিবুকে হাত দিয়ে চুমো খেল তারপর পৌষের রোদে হাঁটা দিল একা একা। রাস্তার মোড়ে গিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পথের বাঁকে হারিয়ে গেল আমার শৈলদি।
এখনো রাস্তায় জয়নগরের-মোয়া ডাক শুনে চমকে যাই ৷ জয়নগর আমার খুব কাছের এক সাতসাগর পারের স্বপ্নের দেশ ৷ জয়নগরের জিনিসপত্র, সেখানকার মানুষজন, সবকিছু কাছে এনে দেয় আমার-শৈলদিকে। আগেরবার যখন মার সঙ্গে ঝগড়া করে শৈলদি চলে গিয়েছিল মনে মনে বিশ্বাস ছিল শৈলদি ঠিক ফিরে আসবে একদিন । বড় হয়ে আগের মতো ভাবতে ভয় পাই, ছোটোবেলার বিশ্বাসের জোর আর সাহস যে কোথায় হারিয়ে গেল !
No comments:
Post a Comment