Sunday, 28 June 2015

আধুনিক কবিতা : চেতনার অনুষঙ্গ : সরসিজ সেনগুপ্ত

আধুনিক কবিতা : চেতনার অনুষঙ্গ

সরসিজ সেনগুপ্ত
 
ভারি মজার একটা খেলা খেলেছিল আমার এক কৌতুকপ্রিয় শিল্পীবন্ধু, প্রখ্যাত এক বাংলা
দৈনিকের সাবহেডিংগুলো কেটে কেটে সযত্নে জমিয়ে একদিন পরপর সাজিয়ে উপস্থিত করেছিল আমার সামনে : ‘একটা কবিতা লিখেছি।’ বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি এক্ষেত্রে প্রতারিত হয়েছিলাম। আমি অবশ্য এর সমান্তরাল একটা প্রতিশোধও নিয়েছিলাম ; আরেক শিল্পীর বাড়ি বসে দীর্ঘক্ষণ একটা কাগজে আঁকিবুকি কেটে তা ফেলে রেখেছিলাম তার কাজের জায়গায়, তিনি চমৎকৃত হয়ে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ ছবি !কার আঁকা ? বিলক্ষণ অামি আনন্দ পেয়েছিলাম - কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।   
এর থেকে একটা কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায়, ইদানীং এবং বেশ কিছুদিন ধরেই ‘আধুনিক’ শব্দটা এতোদূর পর্যন্ত স্থিতিস্থাপক হয়ে উঠেছে যে যেরকম খুশি, যা খুশি একটা কিছু লিখে , তার গায়ে কবিতার নামাবলী জড়িয়ে দিলেই সেটা বেশ দাঁড়িয়ে যায়, অন্তত কবিতা পদবাচ্য হয়ে বাজারে কেটে যায়। এমনটা ঘটার পেছনে অবশ্য দীর্ঘসূত্র  একটা ইতিহাস আছে, নিশ্চয় হঠাৎ করে এটা হয়নি, আর তার সঙ্গে সঙ্গে অাছে আধুনিক শব্দের তাৎপর্য অনুধাবনে নানান অপব্যাখ্যা, আমাদের ব্যর্থতা, অস্পষ্টতা এ সবই । 
উনিশ শতক থেকে শুরু করে এবং বিশ্বযুদ্ধোত্তর ক্রমবর্ধমান জটিল জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে সঙ্গত কারণেই শিল্পীদের মনে হয়েছিল সমকালীন শিল্পে তার প্রতিফলন প্রসঙ্গে। স্বভাবতই তারা চেয়েছিলেন পাঠককে কবিতার মধ্যে দিয়ে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে । শুরু হয়েছিল শব্দ, আঙ্গিক, বাচনভঙ্গী, ছন্দ, প্রতিমা নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরিক্ষা । অবশ্য তাই বলে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে উনিশ শতকের আগে অথবা বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে পদ্য নিয়ে কোনো পরীক্ষা হয়নি। পরীক্ষা এমনই এক দ্বান্দ্বিক  প্রক্রিয়া যার অস্তিত্ব এবং সম্পর্ক সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে ওতপ্রোত । পরীক্ষা ব্যতিরেকে কাব্য, চিত্র, সঙ্গীত, চলচ্চিত্ৰ কোনো মাধ্যমেই প্রগতি সম্ভব নয় । শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই ক্রমে এই পরীক্ষার চেহারা এবং গতির কিছু পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, তখন মধ্যযুগীয় মন্দাক্রান্তা  পয়ারের পরিবর্তে অনেক দ্রুত পাল্টাচ্ছিল কাব্যের পটভূমি এবং তৈরি হচ্ছিল নতুনতর ঘাতপ্রতিঘাত। এই ধরণের পরীক্ষার একটা ইতিবাচক দিক যেমন থাকে, তেমন থাকে একটা বড় নেতিবাচক দিক - এটা অনেক সময়েই আমাদের মনে থাকে না। ‘এক্সপেরিমেন্টাল লেখা’ এবং লেখা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট যেমন খুবই জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি এই সমস্ত পরীক্ষার গেঁজিয়ে যাওয়া দিকগুলোকে চিনে নেওয়া যা সব সময় খুব সহজও হয়তো নয় । এক প্রখ্যাত সুররিয়্যালিষ্ট শিল্পী রেনে মাগ্রিত খুব মজার কিছু ছবি এঁকেছিলেন । চৌখুপি ঘরে পাশাপাশি ঘড়ি, বাকসো, জলের জগ ইত্যাদি আমাদের নানান ব্যবহার্য জিনিসের ছবি একে তার তলায় নাম লেখার সময় সেগুলো একটু অদলবদল করে দিয়েছিলেন। ফলতঃ ছবিগুলো দেখার সময় দর্শকেরা দেখেছিলেন - ঘড়ির তলায় লেখা : বাতাস, জগের তলায় : পাখি - আর এর থেকে স্বভাবতই বোধ ও অভিজ্ঞতার যে বৈপরীত্য হয় তার থেকে দর্শকের সুষুপ্ত চেতনাকে নাড়া দেবার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছিলেন শিল্পী। কিন্তু এই ছবিগুলো দেখার সময় যদি মনে রাখা না হয় যে এটা একটা বিশেষ অবস্থার ছবি এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে, তাহলে ছবিটাকে সত্যিই কি খুব ভাল বলতে পারি আমরা ?
         এরকমভাবেই পাঠকের বোধকে নাড়া দেবার জন্য নানান কলাকৌশল প্রয়োগ করেন কবি, কবিতায় শব্দের মধ্যে আনেন বৈপরীত্য, অপ্রচলিত শব্দ বা বাচনভঙ্গী, সৃষ্টি করেন অনভ্যস্ত প্রতিমা পাঠকের চেতনার গভীরতম স্থানকে ছোঁয়ার চেষ্টায়; আর এই কারণেই আমার বন্ধুর ঐ কবিতা লেখার খেলায় প্রতারিত হয়েছিলাম আমি ।
          এখান থেকে উঠে আসে আরেকটা প্রশ্ন : শুধুমাত্র চেতনাকে নাড়া দেওয়াতেই কি শেষ কবির কাজ ? তাহলে তো বারবার কবিতার নামে ছাইপাঁশ নিয়ে ক্রমাগত ঠকতে থাকবো আমরা। আর ঠকিও কি না যখন নানান পত্র পত্রিকার কবিতার পৃষ্ঠার দুর্বোধ্য কিছু লেখা চমকে দিয়ে ভেসে যায় আমাদের চোখের সামনে অথচ ছুঁতে পারে না কোথাও, অল্প কয়েকজন বোদ্ধা মাথা নেড়ে বলেন - অনবদ্য সুপার্ব। উপরন্তু কবিদের এবং বোদ্ধাদের একটা বক্তব্যও থাকে : কবিতা বোঝার জন্য পাঠকের কোনো মানসিক প্রস্তুতি নেই। একথাটার নিশ্চয় একটা মানে আছে কিন্তু কবির প্রত্যাশারও তো একটা সীমা থাকা উচিৎ ! পাঠকের অপরিণত্বের কথা বলে ব্যক্তিগত ব্যর্থতার ছুঁচ দিয়ে কাব্যের উট গলানোর প্রয়াস বোধহয় ভাল কাজ নয়।
          এটা যে কবিরা সবসময় বুঝে করেন তাও নয়, অনেক সময় নিজের অজান্তে কবিতা লিখতে বসে মজে যান পাঠককে চমকে দেবার নেশায়।তারা ভুলে যান শুধুমাত্র ধাঁধিয়ে দেওয়াটা বিজ্ঞাপনের কাজ শুধু ‘শরীর-শরীর’ এবং সুচিন্তিত শব্দচয়নে একধরনের বিজ্ঞাপন হয় -  কবিতা নয়, আর এরকম করে তাঁরা বিজ্ঞাপন ও শিল্পের ভেদরেখাটাও ভুলে যান কখনো কখনো। নিছক জটিলতা কখনোই আধুনিকতা নয়, শুধুমাত্র চেতনাকে আঘাত করা কবিতার কাজ নয়। যথার্থ আধুনিকতা, আধুনিক কবিতা তাই যা চেতনার অনুষঙ্গ হয়ে ক্রমবর্ধমান  জটিলতার মধ্যে আমাদের সহজ করে তোলে মননে এবং কাজেও। সচেতন করে, সহজ করে তোলে আমাদের জীবনকে। আর এরকম কবিতার পঙক্তিগুলোই জীবনের নানান মুহূর্তে ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে ; তখন আমরা বারবার আউরে যাই সেই সমস্ত লাইন আর কবিতাগুলো, কবিতা এবং জীবনকে একসূত্রে তখন গ্রথিত করতে পারি আমরা, কবিতা তখন অর্থবহ হয়ে ওঠে আমাদের কাছে ।
           ভাল কবিতার কোনো সংজ্ঞা হয়না - এক্ষেত্রে আমাদের সাবজেকটিভ হতেই হয়; ভাল কবিতা তাই যে কবিতা আমাদের ভাল লাগে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জানা দরকার বর্তমানে আমরা যে হুজুগে পৃথিবীতে বাস করি সেখানে আমরা চাই বা না  চাই প্রত্যেকটা শব্দ এবং প্রত্যেকটা রেখার একটা পূর্বনির্ধারিত মানে ঠিক হয়ে আছে বা যাচ্ছে  ঘটনাগত মন্ত্রগত একটা বেধ নিয়ে যেটুকু জানতে চেষ্টা না করলে অজান্তেই আমরা হয়ত মজে যাবো ; সচেতন হতে গিয়ে মেতে উঠবো নতুন কোনো পাগলামীতে কিংবা নেশায় । কিন্তু কি করে চিনতে পারবো আমরা কোনটা সত্যি সত্যিই কবিতা আর কোনটাই বা কবিতা রচনার প্রয়াস? কারণ এও তো ঠিক কবিতার মত কবিতা শেষ অবধি খুব কম কবিতাই হয়ে উঠতে পারে !   - একটা ছোট্ট  বিদেশী উপকথা বলে থামা যাক।
          এক দেশের রাজা একদিন একটা স্বপ্ন দেখলেন। তিনি সেই স্বপ্নের মানে বোঝার জন্য ব্যগ্র হয়ে নানান দিকে লোক পাঠালেন ঢ্যাঁড়া দিয়ে - যে সেই স্বপ্নের মানে বলতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করবেন তিনি। সেই দেশের একজন এই ঘোষনা শুনে ভাবল দেখাই যাক না চেষ্টা করে। সে যখন চলেছে সেই স্বপ্নের মানে বলতে ঠিক সেই সময় তার পথ আটকে দাঁড়াল এক ঢোঁড়া সাপ। সাপ জানালো ঐ স্বপ্নের মানেটা সে বলে দিতে পারে কিন্তু বদলে তাকে লোকটা যে পুরস্কার পাবে তার অর্ধেক ভাগ দিতে হবে। লোকটা রাজি হলো। সাপ তখন বললো : এই স্বপ্নের মানে সমগ্র দেশে এখন চলছে মিথ্যাচার। লোকে ভুলে যাচ্ছে নিজেদের প্রতিশ্রুতি। মেতে উঠেছে শঠতা, প্রবঞ্চনা এবং নানাবিধ অসৎ কাজে। লোকটা গিয়ে রাজাকে জানালো তার স্বপ্নের মানে। চিন্তিত রাজা পুরস্কৃত করলেন তাকে।কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে লোকটির মনে হলো যদি সাপটাকে ভাগ না দিয়ে আমি একাই আত্মসাৎ করি গোটা পুরস্কারটা তাহলে কেমন হয় ? সে আর ঐ পথে বাড়ি না গিয়ে অন্য পথে বাড়ি ফিরলো ।
এর কিছুদিন বাদে আবার স্বপ্ন দেখলেন রাজা । আবারও আগেরই মতো স্বপ্নের মানে বলার জন্য পুরস্কার ঘোষিত হলো । এবার ও লোকটা চললো স্বপ্নের মানে বলতে । অনেক কাকুতি মিনতি করে প্রথমে সাপের রাগ ভাঙ্গিয়ে সে কথা দিল এবার আর সে ফাঁকি দেবে না , সত্যি সত্যিই সাপকে তার প্রাপ্য সম্পদ দেবে । সাপ জানালো - এই স্বপ্নের মানে দেশে এখন চরম অরাজকতা চলছে। লোকে হয়ে উঠছে হিংসাপরায়ণ এবং রক্তলিপ্সু , সদ্ভাব নেই একে অন্যের সঙ্গে। জিঘাংসা পরায়ণতায় ব্যাহত তাদের স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধি। লোকটি গিয়ে রাজাকে জানালো তার স্বপ্নের মানে । রাজা এবারও পুরস্কৃত করলেন তাকে । বাড়ি ফেরার পথে লোকটি নিজের কথা তো রাখলোই না উপরন্তু ধারালো অস্ত্র নিয়ে আঘাত করলো সেই অসহায় সাপকে, আহত সাপ রক্তাক্ত দেহে কোনো মতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালো। একা একাই সমস্ত সম্পদ নিয়ে বাড়ি ফিরলো লোকটি। এ ঘটনার পর কেটে গিয়েছে বেশ কিছুদিন, আবার ও স্বপ্ন দেখলেন সেই রাজা এবং তার মানে বলতে চলল সেই একই ব্যক্তি। পথে সাপকে ডেকে অনুনয় বিনয় করে নিজের ভুল স্বীকার করলো সে, বললো : শেষবারের মতো তাকে একটা সুযোগ দিতে। সাপ বললো : এই স্বপ্নের মানে দেশে সুদিন আসছে। এখন শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে লোকেরা, ভেবে দেখছে তাদের কৃতকর্মের কথা । রাজা এই স্বপ্নের মানে শুনে খুশি হয়ে লোকটিকে প্রভূত পরিমাণ অর্থ দিলেন। লোকটি তা নিয়ে উপস্থিত হলো সাপের কাছে । ইতিপূর্বের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে সাপকে অনুরোধ করলো সেই পুরো অর্থটি গ্রহন করে সাপ যেন তাকে ক্ষমা করে - নিজের ব্যবহারের জন্য এখন যথার্থই অনুতপ্ত সে। তখন সাপ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে স্বপ্নের মানে গুলো ভাবতে বললো। বললো, প্রথমবার যখন সে প্রবঞ্চনা ও শঠতা পরিপূর্ণ সময়ের কথা বলেছিল তখন লোকটি ছলনা করেছিল তার সাথে। দ্বিতীয় বার যখন হিংসাপূর্ণ রক্তলিপ্সু এক সময়ের কথা বলেছিল তখন লোকটি আক্রমন করে আহত করেছিল তাকে এবং তৃতীয়বার যখন সাপ বলেছিল এক শান্তিপূর্ণ সময়ের কথা সেবার নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছে সে।  এর থেকেই পরিস্ফুট হয় স্বপ্নের মানেগুলো ।
       আমরা যেন বিস্মৃত না হই চেতনে অবচেতনে আমরা সকলেই বিস্তৃত দেশকাল সম্পৃক্ত এবং ইতিহাস নিরপেক্ষ নই।  এই সময়ের কবি এবং প্রত্যেকটি সচেতন মানুষই ঐ  আহত সাপের মত আর তাদের কবিতায়, ভালো  কবিতায় নিশ্চয় কোনো না কোনো ভাবে থাকবে তাদের অভিজ্ঞতা - ব্যথা, আশা, নিরাশা মন্ডিত জীবনের ছোঁয়া। আর এই কবিতাকে তখন কবিতা হিসাবে চিনে নেওয়াটা কঠিনসাধ্য নয় , কারন জীবন যাপনের তাগিদে , প্রয়োজনে এই সমস্ত কবিতা অজান্তে হয়ে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় - অপরিহার্য , দুর্বোধ্য কিছু শব্দ এবং বাকচাতুর্য  মাত্র নয়।

No comments:

Post a Comment