Sunday, 7 June 2015

লু স্যুনের গল্প:একটি ক্ষুদ্র মূহুর্ত:অনুবাদ-সুদেষ্ণা মিত্র

লু স্যুনের গল্প : একটি ক্ষুদ্র মূহুর্ত
অনুবাদ : সুদেষ্ণা মিত্র
[লেখক পরিচিতি :  লু স্যুন (১৮৮১-১৯৩৬) , সমসাময়িক চৈনিক সাহিত্যের একজন সম্পদশীল 
প্রতিভা। তিনি কেবলমাত্র একজন সুলেখকই নন, একজন উল্লেখযোগ্য বিপ্লবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। কলমকে অস্ত্র করে তিনি এক কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যান সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র এবং আমলাতান্ত্রিক পুজিবাদের বিরুদ্ধে। তিনি তার একমাত্র জীবনে বহু ছোটগল্প, প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি প্রধানতঃ ঘুনধরা সমাজ ব্যবস্থার সঠিক চিত্রটিকে তার অসামান্য গল্পগুলির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। এই বিশেষ গল্পটি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।]


একটি ক্ষুদ্র মূহুর্ত


        ছয় বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে ঠিক যবে আমি দেশ থেকে রাজধানীতে এসেছি। ঐ সময় রাষ্ট্রের সাধারণভাবে পরিচিত ঘটনাগুলো আমি দেখেছি এবং শুনেছি যা বলতে গেলে একদমই ক্ষুদ্র নয়, কিন্তু এর কোনটিই আমাকে আকৃষ্ট করেনি। যদি প্রশ্ন করা হয় এর কতোটা প্রভাব আমার ওপর পড়েছে, তাহলে বলতে পারি এগুলি আমার বদরাগী মনোভাবকে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে। স্পষ্টতঃ বলতে পারি, এগুলি আমাকে দৈনন্দিন জীবনের জনসাধারণ সম্পর্কে এক দীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েছে।
        একটা ছোট্ট ঘটনা যা আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং আমাকে নাড়া দিয়েছে। ঘটনাটি এখনও আমার স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল  হয়ে আছে।
         ১৯১৭ সালের শীতকালের একটা দিন, এক জোড়ালো উত্তুরে বাতাস এসে আছড়ে পড়ছে, আমার বেঁচে থাকবার অত্যাবশ্যকতা আমাকে সকাল সকাল জাগিয়ে তুলে পথে নামবার শক্তি জুগিয়েছে। অবশেষে ‘এস’ গেট-এ যাবার জন্য এক রিক্সাচালকের সাহায্য নিই। বাতাসের প্রাদুর্ভাব কমেছে, ফলে, রিক্সাচালক আরও দ্রুত হতে পেরেছে। ঠিক যখনই আমরা ‘এস’ গেট-এর কাছাকাছি এসেছি তখনই আমাদের রিক্সাটা একজনকে ধাক্কা দিল এবং সে - খুবই ধীরে হোচট খেয়ে পড়ে।

      সে ছিল এক ধুসর চুলের নারী যার পরনে এক জীর্ণ বস্ত্র  খণ্ড সে রাস্তার ধার থেকে হঠাৎই রিক্সার সামনে উঠে এসেছিল । ভাগ্য ভালো যে রিক্সা চালক তার গতিকে সংযত করেছিল তা না হলে সে নিঃসন্দেহে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হতো এবং এটা হয়তো একটা গুরুত্বপূর্ণ দুর্ঘটনায় পরিবর্তিত হতো ।

     তবুও রিক্সার ওই সামান্য ধাক্কায় সে বিশৃঙ্খলভাবে মাটিতে নিক্ষিপ্ত হল এবং রিক্সাচালককে থামতে হলো । একটা বিষয় আমার কাছে অবিশ্বাস্য যে এভাবে মহিলা আঘাত পেল অথচ কেউই আমাদের দেখতে পেল না । আমি ভাবছিলাম রিক্সাচালক অকারণে নিজেকে এক অসুবিধার মধ্যে টেনে আনল।

       “ঠিক আছে", আমি বললাম, “এবার চলো”, রিক্সাচালক একদমই নজর করলো না হতে পারে সে শুনতে পায়নি রিক্সার হাতল নামিয়ে রেখে সে মহিলার হাত ধরলো এবং নরমভাবে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো৷

      “আপনি ঠিক আছেন?”, সে জিজ্ঞাসা করলো ।

   “আমি নিজেই এই আঘাতের জন্য দায়ী"।

       আমি চিন্তা করলাম ; -  আমি দেখেছি তুমি কতো ধীরভাবে পরে গেলে । তোমার কিভাবে আঘাত লাগলো ? এই ধরনের নাটকীয়তা কি অসহ্য !  রিক্সাচালক মহিলাটির অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু এখন সে  নিজেই এই অসুবিধার মধ্যে পরে গেছে, তার উচিৎ নিজের পথ খুঁজে নেওয়া ।

      রিক্সাচালক বৃদ্ধ মহিলার উত্তর শোনবার পর একমুহূর্ত অপেক্ষা করলো না । তার হাত ধরে তাকে ধীর পদক্ষেপে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করল। আমি বিচলিত হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি পুলিশ চৌকি। জোরালো বাতাসের দাপটে সেখানে আর কেউই ছিল না। রিক্সাচালক বৃদ্ধা মহিলাকে পুলিশ চৌকিতে নিয়ে গেল ।

      হঠাৎ আমার মধ্যে এক অপরিচিত সংবেদনের আবির্ভাব ঘটল । তার ধুলি- ধূসরিত দেহ দ্রুত বর্ধিত লাভ করল । সে দূরে হেঁটে গেল,যতক্ষণ সে অস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল, আমি ততক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে ক্রমে আমার ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আমার বস্ত্রের অন্তর্বতী ক্ষুদ্র আত্মাটাকে শক্তিশালী করে তুললো।

       একদম শক্তিহীন  এবং গতিহীন অবস্থায় বসে রইলাম যতক্ষণ না একজন পুলিশ এসে পৌঁছাল ততক্ষণ আমার মন শূন্য হয়ে রইল । পুলিশ কে দেখে আমি রিক্স থেকে নেমে পড়লাম।              
 পুলিশ আমার কাছে এসে বললে, “আর একটা রিক্সাতে যান। ও আপনাকে আর নিয়ে যেতে পারবে না ।”
        সেইমুহূর্তে আমি আমার শীতবস্ত্রের পকেট থেকে কয়েকটি তামার মুদ্রা বার করে পুলিশকে দিলাম, “দয়া করে এটা ওকে দেবেন”, আমি বললাম ।
        বাতাসের দাপট একদম থেমে গেছে, কিন্তু রাস্তা এখনও শূন্য । হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে লাগলাম , যে ঘটনা ঘটে গেছে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি নিজের কথা ভাবলাম যা আমি খুব কমই ভাবি । আচ্ছা আমি এই তামার মুদ্রার দ্বারা কি ভেবেছিলাম? এটা কি একটা পুরস্কার ? ঐ রিক্সাচালককে বিচার করবার আমি কে ? আমি নিজেকে কোন উত্তর দিতে পারিনি ।
          এমনকি এখনও এই ঘটনা আমার মনে পুনরাবির্ভূত হয়। এই ঘটনা আমার মনে ক্লেশের সঞ্চার করে । নিজেকে নিয়ে ভাববার সুযোগ করে দেয়। শিশুবয়সে যেমনভাবে আমি মার্গীয় সাহিত্য পড়তাম ঠিক তেমনিভাবে ঐ সমস্ত বছরগুলোর রাজনীতি এবং সংগ্রাম আমার মন থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যায়।
          এই ছোট্ট ঘটনা আমার মনে ফিরে ফিরে আসে, প্রায়ই আসে, বাস্তব ঘটনা অপেক্ষা পরিস্কারভাবে, আমাকে শেখায় লজ্জিত হতে, জাগিয়ে তোলে সংশোধনের উত্তেজনা, শুদ্ধ সাহস এবং শুদ্ধ আশায় আমায় অনুপ্রাণিত করে ।

No comments:

Post a Comment