একটি ক্রোধের ইতিহাস
শান্তনীল গাঙ্গুলী
একটি সংবাদ
১৭ই জুলাই তারিখে একটি জনপ্রিয় দৈনিকের একেবারে বা দিকের
কলামে, যেখানে কিছু মুখরোচক ও অকিঞ্চিৎকর খবর ছাপা হয় সেখানে একটি খবর বেড়িয়েছে। হেডিংটি চোখ সওয়া। 'গণপ্রহারে এক পকেটমারের মৃত্যু ’। নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে—“পকেটমারটির বয়স ছিল চোদ্দ -পনের, বৌবাজার স্ট্রিটের উপর সন্ধে ছটা নাগাদ অফিস ফেরত যাত্রীদের মিলিত প্রহারে ছেলেটির মৃত্যু হয়। যদিও পুলিশের মতে মাথায় একটি ভোঁতা অস্ত্রের তীব্র আঘাতেই মুলত: মৃত্যুর কারণ।’
কেন এই মৃত্যু ?
এর উত্তর খোজা যায় বিভিন্ন জায়গায়—
- কোন বিশেষ অর্থনৈতিক কাঠামোয় পকেটমার, চোর, চিটিংবাজের সংখ্যাবৃদ্ধি হয় ?
- কোন বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ফলে শিশু ও কিশোররা অপরাধী হয় ?
- কিরকম পারিবারিক দারিদ্র্য ও পরিবেশগত চাপ ছেলেটিকে পকেটমার করে তুলল ? এবং
- কিরকমভাবে কেটেছিল নিবারণ বাড়ুঁজ্যের ১৬ই জুলাই দিনটি ?
এরমধ্যে প্রথম দুটি বিষয় গল্প লেখার পক্ষে আদৌ উপযুক্ত নয়। তৃতীয় বিষয়টি ক্রমাগত গল্পে-উপন্যাসে পড়ে পড়ে কিরম জানি ক্লিশে হয়ে গেছে। আর তাছাড়া চার নম্বর বিষয়টি পড়লেই প্রশ্ন জাগে বেসরকারী অফিসের পেচোঁ কেরাণী নিবারণ বাড়ুঁজ্যের সাথে কি সম্পর্ক আছে বৌবাজার স্ট্রিটে পড়ে থাকা কিশোরটির।
অতএব শুরু করা যাক নিবারণ বাড়ুঁজ্যের দিনলিপি থেকে -
এ কোন সকাল
প্রতিদিনের মতো এদিনও ঘুমটা ভেঙেছিল কলতলায় বাড়িওয়ালার ঝি-র সাথে রুমার চেঁচামেচিতে । মনে মনে ঠাকুর নাম করে উঠতে গিয়েই কোমরের বাঁ দিকটা খচ্ করে উঠলো। ফলে এই সাতসকালেই একটা গালাগাল করে ফেলে নিবারণবাবু। বাতের ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিয়েছে। মেঝেতে বিছানা পাতা, বড় ছেলেটা এখনও ঘুমোচ্ছে। সারা ঘরটা যেন মশারির মধ্যে ঢুকে গেছে। হাত মুখ ধুয়ে মশারির একটা খুট খুলে দিয়ে বিছানার একপাশে বসে নিবারণবাৰু। তারপর বিস্বাদ চায়ে একটি দীর্ঘ চুমুক দেওয়ার পর দুটো জিনিস দেখে মেজাজটা আরেকবার তিতো হয়ে গেল। প্রথমতঃ বাজারের থলি, দ্বিতীয়তঃ ওই থলি হাতে বড় মেয়ে রুমা। মাসের শেষ হলেও দীর্ঘদিনের অভ্যাসে বাজারের থলিটাকে ম্যানেজ করতে পারে নিবারণবাবু। এর তার থেকে কয়েক টাকা ধার, মাসকাবারী দোকান থেকে আলুটা, ডিমটা - মোটামুটি হয়ে যায়। কিন্তু রুমা ! কোন সমাধান নেই। বুকটা যেন হিম হয়ে যায় । সারা মুখে চেহারায় কোন লালিত্যের অবকাশ নেই। রাতদিন ঝগড়া, অপুষ্টি আর হাড়ভাঙা খাটুনি — সব মিলিয়ে এই বাড়িটার মতোই রঙচটা আর খরখরে হয়ে গেছে মেয়েটা ।
“একটু তো সাজগোজও করতে পারিস। কাগজে তো পড়ি কতরকম সব আছে। ডালবাটা, সরবাটা….”
কথাটা নিজের কাছেই অর্থহীন লাগে। অদ্ভুত শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা । তাড়াতাড়ি থলিটা নিয়ে বেড়িয়ে পরে নিবারণবাবু।
অফিস যাওয়ার অাগে
রাস্তার কাদায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া বাঁ পা টা একপ্রকার টেনে হিঁচরেই আনতে হচ্ছিল। ঠিক জয়দেবের দোকান থেকে বেরনোর পরেই চপ্পলটা ছিঁড়ল। মুচি বসে সেই বাস স্ট্যান্ডে । এইভাবে শম্বুকগতিতে ওখানে গিয়ে চটি সারিয়ে আনতে নির্ঘাৎ লেট। কিন্তু এইভাবে হাঁটা যে কি দুঃসহ বুঝছিল নিবারণবাবু। একে তো প্রতি পদক্ষেপে চটিটা ঘুরে পাশে চলে যাচ্ছে, তার উপর একটু বেকায়দা হলেই কোমরের ব্যাথাটা ইলেকট্রিক শক মারছে। সব মিলিয়েই বড় ছেলের উপর রাগটা বাড়ছিল নিবারণবাবুর। সকাল আটটা অবধি না ঘুমিয়ে বাজারটাও তো করতে পারতো। যদিও রাগটা একটু বেশি চড়ে গেছিলো বলেই বোধহয় মনে পড়লো না। কদিন ওকে দিয়ে বাজার করানোর পর নিবারণবাবুই বারণ করে দিয়েছিলেন ওকে বাজার করতে। প্রথমতঃ বাজার থেকে নিয়মিত একটাকা দুটাকা সরানো। দ্বিতীয়তঃ পুরো বাজারটাই হতো আগোছালভাবে। পয়সার শ্ৰাদ্ধ, সাশ্রয় কিছুই হতো না । কিন্তু এখন এই পথময় কাদা, কোমরের ব্যাথা, নিঃশেষ পকেট সব মিলিয়ে শুধু একটা রাগ দলা পাকিয়ে উঠতে লাগলো। প্রকাশ না করলে যার শান্তি নেই। অথচ প্রকাশ করা গেল না। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই রুমা জানাল সুবোধবাবু এসেছেন।
“আপনার বৈশাখ কিন্তু পেরিয়ে গেলাে,.....কিরম ভদ্রলোক মশাই ……. দেড় হাজার টাকার সুদ বাকি….. এবার কিন্তু গয়নাগুলো…... বলি আর কদিন এ্যাঁ……. স্ত্রীর অসুখ তা মশাই গত একবছর ধরে…… না না এই শেষ…….” ।
সুবোধবাবুর ভয়ংকর কথার স্রোতে নিবারণবাবুর অস্ফূট অৰ্দ্ধস্ফূট কথাগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছিল। হিমশীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিল বুক পিঠ জুড়ে। সুবোধবাবুর কথাগুলোও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। আর এইসব অস্পষ্টতার মাঝে জ্বলজ্বল করছে একটাই চিন্তুা -“গয়নাগুলো বাঁচাতেই হবে ।”
আর ঠিক এই সময়েই হঠাৎ মরিয়া হয়ে গেল নিবারণ বাবু। এবং দরজার পাশে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে থাকা মেয়ে বৌয়ের সামনে এমনি একটা কাজ করে ফেললো যা কোনমতেই ভদ্রজনোচিত বলা চলে না। হঠাৎই নীচু হয়ে সুবোধ মোদকের হাঁটু দুটো ধরে ফেললেন তিনি।
"রুমার বিয়ে…… যৌতুক বলতে শুধুই গয়নাগুলো …... ওই তো দেখতে, গয়না ছাড়া …… আপনার মেয়েরই মতো …... দয়া করুন …... আর কিছু দিন …… নিজে গিয়ে …...”
ছ মাস সময় দিয়ে সুবোধবাবু বেড়িয়ে যাবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ মাটি থেকে ওঠার শক্তি পাচ্ছিল না নিবারণবাবু। পচা ঘায়ের মতো একটা গ্লানি, একটা রাগ, একটা ভয় ঘনিয়ে উঠছিল। আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। সারা কপাল জুড়ে বিন্বিন্ করছে ঘাম। মাথাও তুলতে ইচ্ছা করছে না, মুখ তুললেই তো মুখোমুখি হতে হবে সবার, রুমার সেই ভীষণ শান্ত চোখ দুটো। তবুও উঠতে হল, কারণ ন’টা বেজে গেছে। এবং আজও লেট।
এবং অফিসে
অফিসে ঢুকে সই করবার পর প্রথমে টেবিলটা একটি ঝাড়ন সহযোগে মুছে নেওয়া (ময়লা থাক বা না থাক), হাত মুখ ধোওয়া ও চুল আচরান (প্রয়োজন থাক বা না থাক) , এক গ্লাস জল ঢক ঢক করে খেয়ে নেওয়া (তেষ্টা পাক বা না পাক) ইত্যকার কেরাণীকুলের আবশ্যকীয় কাজগুলি করার পরেই খবর এল খোদ এম. ডি. সাহেব ডাকছেন । অফিসে ঢুকেছেন দশটা পঞ্চাশে । অতএব কিছু একটা হবে...এরকম আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু তা বলে। ……… একেবারে এম. ডি.!
ভারী কাঠের দরজাটা একটি মৃদু অভিজাত শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। দু - দুটাে এয়ার কুলার মেশিন সারা ঘরে ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত ছড়িয়ে দিচ্ছে। পায়ের তলায় কার্পেটের নরম স্পর্শ, মৃদু একটা সুবাস, এয়ার কুলার মেশিনের ভ্রমর গুঞ্জনের শব্দ। সব মিলিয়ে নিবারণবাবুর মনে হল তার উষ্ণ পরিচিত পৃথিবীটা থেকে ওই ভারী কাঠের দরজাটা তাকে একদম আলাদা করে দিয়েছে। বেশ কিছুটা দূরে এক বিশাল টেবিলের ওপাশে। বড় সাহেব একটি ফাইল দেখছে। নিবারণবাবু বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন। সারা শরীরটা কিরম যেন অস্থির লাগছে। মাথার দুপাশটা আবার দপদপ করতে আরম্ভ করেছে। আর না পেরে নিবারণবাবু গলায় একটি মৃদু শব্দ করলেন। বড় সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। সামনের একটি লাল রেক্সিনে মোড়া চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন’, এবং আবার পাঁচ মিনিটের জন্য তিনি ফাইলে ডুবে গেলেন। নিবারণবাবুর মনে পড়লো কি একটা পরীক্ষায় একবার ঠিক তার অাগের ছেলেটিকে দেওয়ার পর প্রশ্নপত্র শেষ হয়ে গেছিল।অফিস ঘর থেকে প্রশ্নপত্র আনা অবধি এক চাঙর বরফের মতো ভয় নিয়ে তাকে বসে থাকতে হয়েছিল।বড় সাহেবের কথা শেষ হতে কিন্তু তিন মিনিটও লাগলো না ।
“আপনার রেকর্ডস দেখলাম …….. হ্যাবিচুয়েট লেটকামার…..বয়স হচ্ছে…….ইউ শ্যুড টেক রেস্ট... বুঝছি কিন্তু কোম্পানীর দিকটাও তো আমাকে...নো, সরি নিবারণবাবু, আই এ্যাম হেল্পলেস ও কে বাট রিমেম্বার এই কিন্তু শেষবার। এরপর প্লীজ আমাকে রিকোয়েস্ট করবেন না ।”
ছোটবেলা থেকেই পরীক্ষা ভালো হোক বা খারাপ, পরীক্ষার পর একটা হয়ে যাওয়ার স্বস্তি পাওয়া যেত। এবার কিন্তু বড় সাহেবের ঘর থেকে বেড়োনোর পর সেই স্বস্তিটা খুঁজে পেল না নিবারণবাবু। সবাই যেন কি এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। উমার শীতল দৃষ্টি, সুবোধবাবুর ঝাঁঝ, কোমরের ব্যাথা, মাথার যন্ত্রণা, বড়সাহেবের শীতল ব্যবহার, বৌয়ের অসুখ সব-সব। এক বিজাতীয় রাগ আবার পাকিয়ে উঠতে থাকে,গলার কাছটা ব্যাথা ব্যাথা করে। চোখে-কানে ঝাঁঝ, এক ভীষণ চীৎকার করতে ইচ্ছা হয় নিবারণবাবুর।
অবশেষে ... অথবা পরিনতিতে
রাস্তায় যেন ঢল নেমেছে মানুষের। গুমোট ভ্যাপসা একটা গরম । টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। তবু ছাতাটা খোলা যাচ্ছে না। সকালে তাড়াহুড়ায় চটিটা সারানো হয়নি। সেফটিপিন লাগিয়ে চলে এসেছে ফলে অনেক সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। নিবারণবাবুর বারমেসে ছাতিটা তাই আপাততঃ লাঠির কাজ করছে।
ভ্যাপসা গরমের তেলচিটে ঘামের সঙ্গে বৃষ্টির জল মিশে কপাল দিয়ে নামতে থাকে। কত লোক ... কত কেরাণী ... এদের সবার বাড়িতে কি উমা বা সুবোধবাবু অপেক্ষা করে আছে।
আগামী দু-মাসের মধ্যে সমস্ত দেনা শোধ করতে হবে। দরকার হলে শুধু নুন ভাত খেয়ে থাকবো। একবার পয়সা চাইলেই বাড়ি থেকে একদম দূর করে দেব কুলাঙ্গার ছেলেটাকে । …… কাল থেকে রোজ ঠিক সময়ে অফিসে আসতে হবে। গিন্নি না পারলে উমা রাঁধবে, মেয়েটাও বেয়াড়া হয়ে উঠেছে, হতকুচ্ছিৎ দেখতে, বিয়ে হচ্ছে না—তাও যেন আমার দোষ, এই রবিবার আবার উমাকে দেখতে আসবে। টাকার শ্রাদ্ধ। আবার, আবার সেই রাগটা দুনিয়ে উঠতে থাকে। রগের শিরাদুটো থেকে মনে হচ্ছে এখুনি ফেটে বেড়িয়ে আসবে রক্তের স্রোত ।
আর ঠিক এই সময়ে পাঞ্জাবির ঝোলা পকেটে একটা টান অনুভব করে নিবারণবাবু। পেছনেও একটা অস্পষ্ট কোলাহল । একটি বাচ্চা ছেলে, গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট পরা, সামনের দিকে ভিড় ঠেলে কোনমতে পালাবার চেষ্টা করছে। ......হাতে একটি অতি পরিচিত ছেড়া-ফাটা কালো মানি ব্যাগ। ব্যাস আর ভাবতে পারে না নিবারণবাবু। সারাদিনের...নাকি সারা বছরের ...নাকি সারাজীবনের রাগটা মুহুর্তে সংহত হয় কালো ভারি ছাতাটিতে আর তারপর ফেটে পড়ে ছেলেটির মাথা লক্ষ্য করে। এরপর চীৎকার, চেঁচামেচি আরও অনেক নাম না জানা নিবারণবাবুর ভিড়ে হারিয়ে যায় ছেলেটি।
তারও পরে
সন্ধের অনেক অনেক পরে, খোঁয়া ওঠা কাদায় ভর্তি গলি দিয়ে ছড়িটাকে আঁকড়ে ধরে টলতে টলতে বাড়ি ফেরে নিবারণবাবু।
No comments:
Post a Comment