Saturday, 14 May 2016

ছবি ও দানব - দুটোই সত্যি : সৌমিক নন্দী মজুমদার

ছবি ও দানব - দুটোই সত্যি
সৌমিক নন্দী মজুমদার
 বিহার - বাংলার আদিবাসী সমাজে পটুয়া বা চিত্রকরদের ঘরে একটা মজার গল্প বলা হয়।
অঞ্চল বিশেষে গল্পটার একটু হেরফের হলেও তার মোদ্দা অংশটি হল এই যে একটা ভয়ংকর দানবের উৎপাতের অতিষ্ঠ গ্রামবাসীরা পড়েছে মহা ফাঁপড়ে। কোন কিছুতেই ডর খায় না এই অসীম শক্তিশালী দানবটা, আর সরাসরি সংঘর্ষে তাকে ঘায়েল করা তো নিতান্তই অসম্ভব। এরকম সঙ্কটের মধ্যে, সে অঞ্চলের এক চিত্রকর করল কি - গভীর রাতে, দানবটা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন চুপি চুপি গিয়ে দানবের গুহার ঠিক উল্টো দিকের পাহাড়ের গায়ে আরেকটা বিশাল দানবের ছবি একে চলে এল। পরদিন সক্কালে মাঠে যাবে বলে তৈরি হয়ে, যেই না দানবটা বেরিয়েছে গুহা থেকে আচমকা উল্টো দিকে ওই রক্তবর্ণ চক্ষু, শিং ওয়ালা, দাঁতাল দানবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, গাড়ু- গামছা ফেলে, সাত লাফে হাওয়া ......। দানবের আতঙ্ক থেকে গ্রামবাসীরা তো মুক্ত হলই, চিত্রকরেরও সন্মান গেল বেড়ে।  
          গল্পটা শুনে আমাদের হাসি পায় দানবের বোকামি দেখে যার কিনা এত শক্তি, এত দাপট, সে একটা সামান্য আঁকা দানবকে দেখে ভয় খেল ! আর উল্টো দিক থেকে বিস্ময় জাগে অন্য একটা কথা  ভেবে - এত হম্বিতম্বি, লড়াই  করে যার গায়ে আঁচড়টি লাগানো গেল না, শেষে একটা ছবি তাকে তাড়িয়ে ছাড়ল । তার মানে কি এই যে দানব্কে হারিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা একটা ছবির আছে !
         ছবির  ওপর যে ধরনের প্রায়-অলৌকিক  বিশ্বাসের কথা নিহিত আছে এই গল্পের মধ্যে, তা কি শুধুই এই গল্পের একটা মজাদার উপকরণ মাত্র, নাকি তার চেয়ে আর একটু বেশি ইঙ্গিত নিতে পারি এর থেকে ? ছবির ক্ষমতার ওপর এই বিশ্বাসের কথা থেকে , মানুষের সঙ্গে ছবির এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক কি বুঝে নিতে পারি - যে সম্পর্কের একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে, আছে হয়তো সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা !
           হাজার  হাজার বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা ওদের বাড়িতে (অর্থাৎ কিনা পাথুরে গুহায়), দুপাশের রুক্ষ দেওয়াল এবং ওপরের সিলিং ভরিয়ে দিত অজস্র জীবজন্তুর ছবি এঁকে। তার মধ্যে বাইসনের মতো সুস্বাদু অথচ হিংস্র প্রাণীর ছবির ওপর এঁকে রাখত অজস্র তীর - সম্ভবত এই বিশ্বাসে যে, ছবিতে তীর বর্শা আঁকা থাকলে সত্যিকারের শিকার গুলিও সফল হবে, তীর গুলো লাগবে ঠিকঠাক আসল বাইসনেরও গায়ে ; ছবির একটা magical প্রভাব গিয়ে পড়বে বাস্তব জীবনে। ফলে তাদের কাছে ছবি আঁকাটা কোনো বিচ্ছিন্ন নান্দনিক চর্চা নয়, ছবির ক্ষমতার ওপর এই প্রায়-অলৌকিক বা ‘magical’ বিশ্বাস ছবি আঁকাকে সরাসরি যুক্ত করে নেয় জীবনের সঙ্গে, স্রেফ বেঁচে থাকারই একটা শরীরী অংশ হয়ে ওঠে ছবি।
           একবার এক বিদেশি নৃতত্ত্ববিদ যখন এক আফ্রিকান আদি গোষ্ঠীর গ্রামে কিছু মোষের ছবি এঁকে নিচ্ছিল নিজের কাজের জন্য, ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিল সেই গাঁয়ের লোকেরা কেননা তাদের মোষ নাকি চুরি করে পালাচ্ছিল সেই বিদেশিটা। বিদেশি তো হতভম্ব, কারণ তার সভ্য শিক্ষায় সে জানে যে ওটা মোষের ছবি, অথচ ওই ‘আদিম’ মানুষগুলো মনে করছে যে ওটা সত্যিই ‘মোষ’। সভ্য হবার তাড়নায়, এখনও যে ওরা ছবি আর জীবনের মধ্যেকার মিলে মিশে যাওয়া সম্পর্কটি নষ্ট করেনি। ওই সামাজিক নকশায়, ছবি ওদের কাছে অত্যন্ত বাস্তব, বাস্তবের বিকল্প নয় বা বাস্তবের প্রতিফলন নয়। (‘ শিল্পকলা জীবনের দর্পণ’  ইত্যাদি সাফাই গাওয়ার প্রয়োজন আমাদেরই হয় যারা কিনা জীবন চর্চা ও শিল্প চর্চার মধ্যে একটা পাকাপাকি বিচ্ছেদ আধুনিকতার ভোর বেলাতেই করে রেখেছি !)
         তাই আদিম গুহা মানবের ছবি প্রসঙ্গে ‘magical’ ব্যাখ্যাটা যেন একটু আরোপিত, কারণ তাদের কাছে বাইসনের ছবিটা আসল বাইসনের কোনো ‘বিকল্প’ নয়, বরং ওটা আর একটা বাইসন। সতত সংঘর্ষময় সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে, দেওয়ালের গায়ে আঁকা বাইসনটা স্পষ্টতই জঙ্গলের কঠিন বাস্তবকে ভুলে থাকার জন্য নয়, বরং ঠিক উল্টোটাই সত্যি, ওটা বাইসনের ‘ছবি’ বলে কোনো অবহেলার বস্তু নয়, তাই তীর দিয়ে ( এবং সেটাও এঁকেই ) মেরে ফেলতে হয় ওকে দ্রুত । নয়তো সেই গল্পের দানবটার মতো পালাতে হত তাকে গুহা ছেড়ে ।
          তবুও আমরা বার বার সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট সরিয়ে ফেলে এটাই ভাবতে ভালবাসি  যে ছবি বা যে কোন image-এর ওপর এরকম শক্তি আরোপ করা রীতিমতো ভীতু, সঙ্কীর্ণ, অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার পরিচয়, বাস্তবের সঙ্গে ছবিকে এভাবে গুলিয়ে ফেলা নিতান্তই এক ‘uncultured’ প্রবণতা। তাই যদি হয়, তাহলে কোন ‘culture’- এর আস্থা নিয়ে আজও আমরা ( এমনকি বামপন্থায় বিশ্বাসীরাও ) বিরোধী নেতার কুশ পুত্তলিকা দাহ করি? এক্ষেত্রে ঘটনাটা যদি যদি শুধুই symbolic বলে দাবি করে থাকি, তাহলে নিজের কোনো প্রিয় স্টারের ছবি ফালা ফালা করে ছিঁড়ে দেখা যাক তো সত্যিই আমরা কতক্ষণ ‘আধুনিক’ ভাবে নির্বিকার থাকতে পারি? বহু ব্যর্থ প্রেমিকেরা কেন সমস্ত দেশকালেই তাদের প্রেমিকাদের ছবি আগুনে পুরিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তাদের মন থেকে? একটা ছবি - তা সে হাতে আঁকাই হোক, বা ফটোই হোক বা খড়ের পুতুলই হোক - তার উপস্থিতি কি এতটাই মানসিক প্রভাব ফেলে? বাইসন বা দানবের ছবির ওপর সেই ভরসা সত্যিই কি কোনো primitive instinct  বা আদিম প্রবণতার মতো আজও কাজ করে আমাদের অর্ধচেতনে !
          নৃতত্ত্ব যেমন মানব ইতিহাসের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জমিতে এই ধরনের আদিম প্রবণতার চোরাস্রোত অনুসন্ধান করেছে, শিল্পতত্ত্ব তেমনি বুঝবার চেষ্টা করে যে এই সমস্ত প্রবণতার ধাক্কায় ছবির ধরণ-ধারণে ও ব্যবহারে কী বিপুল বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। এই বৈচিত্র্য মন দিয়ে লক্ষ্য করলে ধীরে ধীরে একটা জিনিস আমরা বুঝতে পারি যে ছবির ওপর কেবল ‘ভরসা’ বা ‘বিশ্বাস’ করেই মানুষ ছেড়ে দেয় না, নানানভাবে তার কার্যকারিতা অবশ্যম্ভাবী করে তোলার প্রয়াস নেয় যেমন গুহামানবের আঁকা বাইসনের ছবির প্রকাশভঙ্গীতে ওই দুর্ধর্ষ প্রাণবন্ত রূপ ওই ছবিটা আঁকার উদ্দেশ্যকেই অবশ্যম্ভাবী করে তোলার প্রচেষ্টা। ছবিটা যত আসল বাইসনের অনুভব তৈরি করবে ততই সে কার্যকরী হয়ে উঠবে, এবং এই আসল বাইসনের  অনুভব তৈরি করা হচ্ছে এক বিশেষ অঙ্কন শৈলীর ওপর নির্ভর করেই। শুধু ‘বিশ্বাস’ দিয়ে নয়। আবার কখনো কখনো, বিশেষ কোন অঙ্কন রীতি বা শৈলী নয়, ছবিকে নানান আচার-ব্যাবহারের (ritual) মধ্যে দিয়ে তাকেই কার্যকরী করে তোলার চেষ্টা হয়। যেমন গুজরাতের কোন কোন গ্রামে পিথরো  পুজোর সময়ে আঁকা দেওয়াল-চিত্রগুলির মধ্যে কোন নির্দিষ্ট অঙ্কন রীতি সচেতন ভাবে কেউ অনুসরণ করে না, যে যার মতো তার নিজের অনুভব দিয়ে এঁকে রাখে ছবিগুলো । হোলির দিনে নির্দিষ্ট সময়ে পুরুত এসে তার যাদু-দণ্ড দিয়ে দেওয়ালে আঁকা প্রতিটি বস্তু ছুঁতে থাকলে তবেই বস্তুগুলো ‘প্রান’ পেতে থাকে একে একে। এই বিশেষ প্রথাটাই ছবি গুলোর প্রানের নির্ভর। এবং শুধু পিথরো  দেবীর ছবি নয়। গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো যে কারুরই এঁকে যাওয়া যা কিছু জিনিস, তা সে  জামগাছ, লাঙ্গল, কুয়ো, বৃষ্টি, এরোপ্লেন, শ্রীদেবী, যাই হোক না কেন, সবই হয়ে ওঠে সপ্রান, আসল বাস্তব। আবার ছবিটাকে ঠিক কোথায় এঁকে ব্যবহার করলে তা ‘সত্যি’ হয়ে ওঠে, এই চিন্তার ছাপ দেখা যায় প্রাচীন মিশরে আকাশ-দেবী ‘নাত্’ এর  ছবির ব্যবহারের মধ্যে।  ‘নাত্’ দেবীর ছবি আঁকা হতো একেবারে কফিনের ভেতরে, যাতে করে মৃত ব্যক্তিকে শোয়ানো যেতে পারত একেবারে ‘নাত্’- এর কোলেই - তবেই না মৃতের স্বর্গ প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় ! এভাবেই তারা বর্তমান জীবনের সীমিত পরিধিকে অতিক্রম করিয়ে নিয়েছে, ছবির প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে এবং এই প্রয়োগ-ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রেখে।
         কখনো বা স্রেফ আকারের বিশালত্বই ছবির সম্মোহনী শক্তির অন্যতম কারন হয়ে দাঁড়ায় । যেমন, অজন্তায় প্রায় দোতলা বাড়ি সমান বৃহৎ বুদ্ধের মূর্তি,  অথবা নাৎসী যুগে স্বস্তিক চিহ্ন এবং হিটলারের প্রতিকৃতির বিশাল বিশাল ছবি । এই কিছুদিন আগেও ক্রেমলিনের রাস্তায় ঝোলানো হয়েছে লেনিনের চল্লিশ ফুট ব্লো-আপ। একদম বিপরীত মেরুর এই দুই রাজনৈতিক মতাদর্শের চাপ তৈরি করা হচ্ছে একই উপায়ে -- বিশালত্ব, যা কিনা কর্তৃত্বব্যঞ্জক, মহাশক্তিশালী। আর এই সমস্ত রাষ্ট্ৰীয় প্রচারমূলক ছবি শৈলীগত দিক থেকে ব্যবহার করেছে সেই ক্ল্যাসিক্যাল ভাষা, যার লক্ষণ হল চিরস্থায়ীত্বের দাবী, শ্রেষ্ঠত্বের দাবী, ফলে তারা যেন প্রশ্নাতীত, সন্দেহ না করে গ্রহণ করার ।

            আবার এটাও দেখতে পাই যে বিশেষ রাজনৈতিক অভিসন্ধিপুষ্ট  কোনো সনাতনী প্ররোচনার জন্য দরকার হয় ঠিক তার উল্টো, অর্থাৎ জনপ্রিয় 'popular’ আঙ্গিকের ভাষা। ফলে আজকের রামের বিভিন্ন ছবিতে ( বড় কাট-আউট, ক্যালেন্ডার বা কার্ড ইত্যাদি ) আঙ্গিক সরাসরি উঠে এসেছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র প্রভাবিত এক ‘হিরোর’ image থেকে ইলোরা থেকে মোটেই নয় । যে সমস্ত ব্যবহারিক ভঙ্গিমার প্রতি আমরা লোভী ( করে তোলা হয়েছে?) --অর্থাৎ মুখের এবং গোটা শরীরের চেহারা, অভিব্যক্তি, পোশাক-আশাকের রঙ - সমস্ত কিছুই করে তোলা হয়েছে আজকের রামের বৈশিষ্ট্য। ফলতঃ যেন সেও উল্টে হয়ে ওঠে জনপ্রিয় অতএব শক্তিশালী। সত্যি কথা বলতে কি, বিশাল জনসভার সামনে যে ভঙ্গীতে  ‘জয় শ্রীরাম’ এখন তীর ছোঁড়ে  সেই একই ভঙ্গীর ভেতর তীর-ধনুকের পরিবর্তে  একটা অটোমেটিক রাইফেল দিলেও ঠিক খাপ খেয়ে যায়। রামের নয়া জন্মতত্ত্ব  নিয়ে যে সব ভিডিও তৈরি হয়েছে সেগুলোতে পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা হয়েছে বলিউড—থ্রিলারেরই আঙ্গিকগত করণ-কৌশল,  এবং শুধুই এ ধরণের mass-media নয়, ছোট্ট নিরীহ দেশলাই বাক্সের ওপর কমলা পদ্মফুলের ছবি ছেপে শ’য়ে শ'য়ে রান্নাঘরের ভেতর প্রবেশ করতে পারে একটা বিশেষ ছবির পরিচিতি । বারংবার, ক্ৰমাগত এই পরিচিতির মধ্যে দিয়ে ক্রমশই ছবিটা হয়ে উঠতে পারে শক্তিশালী all powerful.

            “Clearly the decisive function of art was to exert power— power over nature, an enemy, a Sextual partner, power over reality, power to Strengthen human collective.” অস্ট্রিয়ান ভাবুক আর্নষ্ট  ফিসার বহুদিন আগেই বুঝেছিলেন কথাটা। তারও অনেক অনেক আগেই অবশ্য কথাটা বুঝেছিল গুহামানবেরা বা সেই আদিবাসী গল্পের চিত্রকর । ব্যাপারটা টের পেয়েও অবশ্য তখনও বুঝতে পারে নি গল্পের সেই দানবটা, নইলে ছবির দানবের গায়ে কিছু বর্শা-বল্লম এঁকে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত । যে কোনো কারণেই হোক সে বোধহয় ছবিটা অাঁকতেই জানতো না । এদিকে আজকের দানবেরা যখন ছবি আঁকতে শিখে যাচ্ছে, গল্পের দানবের বোকামিটাই যেন আমাদের না পেয়ে বসে !
  

No comments:

Post a Comment