Saturday, 5 December 2015

প্রবন্ধ - নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন : বিশ্বজিৎ দাসগুপ্ত

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন

বিশ্বজিৎ দাসগুপ্ত



      একটা গল্প বলা যাক। না, কোন কাল্পনিক গল্প নয় ; নয় কোন নিছক কল্পনা বিলাস । একটা বাস্তব যুদ্ধের গল্প। গল্প না উপন্যাস ? 
পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়েই বলছি যে উপন্যাসের সব উপাদানই বিষয়কে সাজিয়ে তোলায় এটি উপন্যাস। আমার উপন্যাসের বিষয় যুদ্ধ। দুই বিপরীত শ্রেণীতে অবস্থানরত দুই পক্ষের যুদ্ধ উপন্যাসের ভিলেন মানে খলনায়ক হল পাচজন—চারজন দেশী ও একজন বিদেশী। যদিও ঐ বিদেশী ভিলেনটিকে চিনতে ভুল করলেই কিন্তু সর্বনাশ– ভিলেন ফচকে নায়ক হয়ে যেতে পারে। উপন্যাসের স্বদেশী চার ভিলেন হল আমাদেরই চার সরকার—গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও ভারত সরকার। আর দেখবেন সব কুঁচে ভিলেনদেরই দাদা গোছের কেউ থাকে এই উপন্যাসে সেই দাদাটি হল বিশ্ব ত্রাস সৃষ্টিকারী ব্যাঙ্ক বা বিশ্বব্যাঙ্ক । উপন্যাসের নায়ক ? হ্যাঁ, মানুষ অগণিত নিপীড়িত আদিবাসি মানুষ – অধিকাংশই ভিল ও তাদের পক্ষে সংগ্রামরত অসংখ্য সংগ্রামী মানুষই আমার উপন্যাসের নায়ক।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হল নর্মদা ও তার পার্শ্ববতী বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আমার আপনার পরিচিত সেই প্রিয় নদীটি যা মধ্যপ্রদেশের মহাদেও পাহাড়ের অমরকণ্টক থেকে উৎপন্ন হয়ে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৩১২ কিমি পথ পরিক্রমার পর আরব সাগরে এসে মিশেছে। সেই প্রিয়তমা নর্মদাই এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। এ সেই নর্মদা যার নরম চুম্বনে চারিপাশ সবুজের সজীবতায় ভরে উঠেছে। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে তার ঐশ্বর্যের ডালি খুলেছে আর ঐশ্বর্যময় প্রকৃতির গভীর আলিঙ্গনে দরিদ্র আদিবাসীরা বন্ধনেই মুক্তির স্বাদ-আস্বাদন করে যুগ যুগ ধরে জীবন যুদ্ধের রসদ কুড়িয়ে চলেছে। এ আমাদের সেই প্রিয়তমা নদী যার স্নিগ্ধ ভালবাসায় বেড়ে ওঠা সবুজ প্রকৃতির সাথে ভারতের আদিমতম আদিবাসী ভিলদের নাড়ীর যোগ যে নাড়ীর স্পন্দনে তাদের জীবন স্পন্দিত। সেই নাড়ীর যোগ আজ উন্নয়ণের কুঠারাঘাতে ছিন্নভিন্ন—আকাশে বাতাসে শুধু মূলহীন (rootless ) আদিবাসীর যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস-অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। এবার আসুন একটু খুলেই কাশা যাক...... ।
       নর্মদার উপর বিভিন্ন অংশে ৩০টি বড় ১৩৫টি মাঝারী এবং ৩০০০ এর মতো ছোট ড্যাম বা জলাধার তৈরীর কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। ড্যামগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি ড্যাম গুজরাটের “সর্দার সরোবর প্রকল্প”ও মধ্যপ্রদেশের “নর্মদা সাগর প্রকল্প”কে ঘিরে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কেন প্রতিবাদ ?
     সত্যিতো এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে যেক্ষেত্রে আমরা বইতে পড়েছি যে জলাধার নির্মাণের উদ্দেশ্য হল সমাজকল্যাণ যেমন সেচে জলের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কি জানেন আমরা মধ্যবিত্ত তো তাই  অনভ্যস্ত মনে নীচু তলার দিকে আর তাকান হয়ে ওঠে না । ভুলে যাই যে কতিপয় মানুষের সুখ কি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে অসংখ্য মানুষের দুঃখের সাথে । হা ঠিকই ধরেছেন । এই প্রকল্পটির সাথেও জড়িয়ে আছে কতিপয় মানুষের সুখ আর অসংখ্য মানুষের বুকফাটা কান্না। । উপন্যাসকে এগোতে দিন বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
কেন এই প্রকল্প ? গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে জল বণ্টনগত কিছু sophisticated সমস্যা, আমলাদের ভোগ লালসা, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিজের আঁখের গোছাও মনোভাব, মন্ত্রী ও অামলাদের পেটোয়া লোকের মুনাফা এবং উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষকে খুশী রেখে ভোট পাওয়া— এইসব গুরুত্বপূর্ণ (?) উদ্দেশ্য রূপায়িত করার জন্যই এই প্রকল্প। অবশ্য আপনি যদি সরকারী তথ্য ও বড়লোকের পা চাটা বড় বড় পত্রপত্রিকাগুলির উপর ভরসা রাখেন তাহলে অন্যকথা । তাই ভরসা থাকুক প্রকল্পটির সাথে জড়িত হাজার হাজার দরিদ্র আদিবাসী মানুষের বুকফাটা কান্নায় । সর্দার সরোবর প্রকল্পটি রূপায়িত হলে গুজরাটের বারুচ এবং বরোদা মিলিয়ে মোট ১৯টি গ্রাম ও মহারাষ্ট্রের ধুলিয়ায় মোট ৩৩টি গ্রাম সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে  যাবে – ৩০ হাজার দরিদ্র আদিবাসী হবে বাস্তুহারা। এছাড়া মধ্যপ্রদেশের ‘ধর’-এ ৮০টি, ঝাবুয়ায় ২৬টি এবং পশ্চিম নিমারে মোট ৭৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে যাবে যার ফলে ৭০ হাজার মানুষ হবে ছিন্নমূল। সোজা ভাষায় প্রকল্পটি ২৩৪টি গ্রামের মোট ১ লক্ষ গরীব আদিবাসীকে তার চেনা জগৎটি থেকে সমূলে উৎখাত করবে। এবার মধ্যপ্রদেশের কথায় আসা যাক। মধ্যপ্রদেশে নর্মদা সাগর প্রকল্পটি রূপায়িত হলে খাণ্ডোয়া, দিওয়াস ও হোসেঙ্গাবাদের যথাক্রমে ১৬৭টি, ৩৯টি ও ৪৮টি গ্রামের মোট ১,৭০,০০০ মানুষ হবে বাস্তুহারা । এক কথায় বড় মাঝারী ও ছোট ড্যমগুলি মিলিয়ে মোট ৫-৬ লক্ষ মানুষ তাদের যুগ যুগান্তরের ভিটে হারাবে। এছাড়া প্রথম প্রকল্পটির দরুণ মধ্যপ্রদেশের প্রায় ৫৩টি গ্রাম জলের নিম্নমুখী টানে (back water effect) জলের তলায় তলিয়ে যাবে। কি বলছেন ? সরকারী পুনর্বাসন ? না মশাই আমার উপন্যাসের খলনায়কেরা মোটেই অতটা অমানবিক নয় । বরং পুনর্বাসনের কথা তারা বহুল অর্থ ব্যয়ে সরকারী পা চাটা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে লিখছে। তবে তারা সব প্রগতিশীল পত্রপত্রিকা ও গণসংগঠনগুলোকে চমকে দিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা নিপুণ হস্তে বহুগুণ কমিয়ে এনেছে, আর আয়-ব্যয়ের এক আকাশ দূরত্বকে প্রযুক্তিগত কৌশলে বেশ অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে। আর অবাক না হলে বলি কি অসাধারণ নৈপুণ্যের ছোয়ায় বাস্তুহারা সকল আদিবাসীকে পুনর্বাসনের জমি বরাদ্দ করে দিয়েছে। তবে এটা নিশ্চয়ই মানবেন যে মানুষ মাত্রই ভুল করে । সরকারও কোন ব্যতিক্রম নয়। তাই দেখা গেছে সরকার প্রতিশ্রুত পুনর্বাসনের বহু জমিই বাস্তবে ভারতের মানচিত্রে নেই। “নর্মদা ট্রাইবুনালের” শর্ত ছিল , যে জমির মালিক মোট জমির ২৫ শতাংশ হারাচ্ছে কম করে সেই পরিমাণ জমি ( ন্যূনতম ৫ একর ) ফেরৎ পাবে । কিন্তু জমির পরিবর্তে জমির এই শর্তটি নিশ্চয়ই খুব কড়া তামাকের ছিল নইলে আপনারাই বলুন সরকার প্রতিশ্রুত জমির শতকরা ৯০ ভাগ কি করে মানচিত্রে থাকে না বা অধিকাংশই নিম্নমানের হয় কিংবা কেমন করে অন্যান্য গ্রামের গোচারণ ভূমিকে বিলকুল পুনর্বাসনের জন্য স্থির করা হয় ? এবার ঐ আদিবাসীদের সাহসটা একবার ভাবুন তো যারা ঐসব গ্রামের মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত গোচারণভূমিতে বাসা বাধতে যাবে ? বুঝিনা সরকার মানুষকে বোকা পাঠাঁ ভাবে নাকি অমেরুদণ্ডী কোন প্রাণী ? ও হ্যা আয়-ব্যয়ের হিসাবটা মধ্যবিত্ত আবেগের বশে বলতেই ভুলে গেছি। এবার একটা ছোট হিসাব খাড়া করা যাক। অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির সাথে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির দিকটা যুক্ত করলে নর্মদা সাগর প্রকল্পটির (NSP ) দরুণ মোট ব্যয় হবে ৩৪৩৭০ কোটি টাকা ও আয় হবে ৬০০ কোটি টাকা অার সর্দার সরোবর প্রকল্পটির দরুণ ব্যয় হবে ২২০৯০ কোটি টাকা তুলনায় আয় দাড়াবে ৬৫৪০ কোটি। আর প্রতি বছরের টাকার অবমূল্যায়ণ, মুদ্রাস্ফীতি, ও সর্বোপরি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাতে প্রকল্পটির রূপায়ণের বিষয়টি ধরলে সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটা অসীম হবার সম্ভাবনাটা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় কি ? একটা গোটা প্রকল্প কোন যুক্তিতে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাতে রূপায়িত হতে পারে তা আমাদের ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেয়। ‘আর এই বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে যে উন্নয়ণের নামে তার তলানিটুকু এসে ঠেকছে কুচের মত প্রবল খরা প্রবণ এলাকায়। তাহলে আলোচনাটা থেকে যে চিত্রটা পাওয়া গেল তা হল এই “উন্নয়নমূলক” প্রকল্পের দরুণ সর্বাধিক ক্ষরাপীড়িত এলাকা পাবে সর্বাপেক্ষা কম সুবিধা আর যাবতীয় সুবিধা সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়বে উচ্চবিত্ত ও ধনী মানুষের শ্রেণীতটে।” 
কেন্দ্রীয় সরকার কি করছে ? আরে মশাই আস্তে। এত উত্তেজিত কেন ? কি না করছে বলুন তো। দেখুন না পরিবেশ দপ্তরের আপত্তি (তথ্যের ভিত্তিতে ) সত্ত্বেও ভোটের স্বার্থে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে। বলে না বিপদে পড়লে ছুঁচোতেও লাথি মারে। তাই দুঃখজনক হলেও ভোটে অবশেষে হারতেই হল কংগ্রেসকে। তা যাকগে সে কথা বিশ্বব্যাঙ্ক যখন ছাড়পত্র দিয়েছে তখন অনুমোদন না দেওয়া মানে বেকার ছেলের বাবাকে অপমান করার মত ঘটনা। অগত্যা …...। কি করল বিশ্বব্যাঙ্ক ? একদল লোক পাঠিয়ে লোক দেখানো একটা Survey করল, ক্ষয়ক্ষতির দিকটা বিন্দুমাত্র না দেখে দুম করে টাকা ধার দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল। আর খেসারৎ মেটাতে এই প্রবল বিদেশী মুদ্রার সংকটকালে একটা গোটা বিধ্বংসী প্রকল্পের জন্য সরকার বছর বছর মোটা অংকের সুদ গুণতে রাজী হয়ে গেল ।
কিন্তু এরা বোধহয় বারবার ভুলে যায় যে ইতিহাসের গতিটা সরলরৈখিক নয়, বরং দ্বন্দ্ব সংকুল। তাই গতানুগতিকতার বাইরে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেই। ঘোষিত হয় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বাঁধভাঙা জলের বেগে ধাবিত হয় বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্ম। চলে হরতাল । চলে বিক্ষোভ। আছড়ে পড়ে গণ আন্দোলনের ঢেউ। মানুষ হয় সংঘবদ্ধ। নর্মদা বাচাও আন্দোলন তাই ইতিহাসের পথ বেয়েই নেমে আসা এক গণ আন্দোলন। যে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ আজ বাতাসের ভরা বেদনায়। আজ সেই আগুনের ফুলকি ধীরে ধীরে আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকার ও বাবা অামতের ছোঁয়ায় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। মেধা পাটকারের মতে আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে পথে চলেছে তা জনবিরোধী। মানুষ আজ প্রকৃতি থেকে ক্রম বিচ্ছিন্ন। প্রাকৃতিক সম্পদ আজ কিছু লোকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তাই অামাদের ছিনিয়ে আনতে হবে প্রকৃতির উপর মানুষের সমানাধিকার । মেধা পাটকারের মতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন সমগ্র আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না । আমাদের এই ভোগবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পদের অসম বণ্টন সম্পর্কে সচেতনতার মধ্য দিয়েই পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন একটি সামাজিক রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে। তাই আজ সময় এসেছে প্রকৃতি আর মানুষের গভীর সম্পর্কটিকে বাচিয়ে রেখে প্রকৃতি মূখী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার । তার মতে মানুষ তখনই আরও বেশী বেশী করে প্রকৃতির সাথে যুক্ত হতে পারে যখন মানুষ এক শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজের বুকে দাড়াবে।
“নর্মদা বাচাও আন্দোলন” ও তার নেত্রী মেধা পাটকারকে হাজার স্যালুট জানিয়েও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্ন ওঠে আন্দোলনের চরিত্র ও তার অভিমুখ নিয়ে। কোন পথে চলেছে এই আন্দোলন ? মেধা বলেছেন যে সমগ্র সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শক্তির সাথে এই আন্দোলনকে যুক্ত করার কথা । কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এই বিষয়টি বাস্তবে ঘটছে কি ? কিঞ্চিত বিচ্ছিন্নতায় মানে অন্যান্য শক্তিগুলি থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়েই কি বেঁচে থাকার একটা ইচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না ? আমার কাছে এই পারম্পরিক যুক্ত হওয়ার পদ্ধতিটি কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন। আশা করি এই লড়াই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কার্যকলাপ অামার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেবে। 
এবার আসুন নর্মদার আশেপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে উদ্দাম যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার কিছু ক্লিপ তোলা যাক ।
 মধ্যপ্রদেশের ‘কোথাদা’ ও আশেপাশের গ্রামে আদিবাসীরা যখন অহিংস পথে আন্দোলনরত—শুধুমাত্র পোষ্টারিং ও শ্লোগানের (‘আমরা ডুবব তবু ড্যাম তৈরি হতে দেব না' ) মাধ্যমে ড্যাম তৈরির বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন সশস্ত্র সৈন্য পাঠিয়ে নারী পুরুষ-বয়স্ক-শিশু নির্বিশেষে প্রায় ২৫০ জন আদিবাসীকে পিটিয়ে জেলে ভরা হয়। ঠিক একই ভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে গুজরাটের মেনীবেলী গ্রামের আদিবাসীদের জীবনে। গ্রামবাসীকে জানানো হয় একমাসের মধ্যে গ্রাম খালি করে না দিলে বন্যার জলে ডুবে মরা ছাড়া অন্য কোন পথ থাকবে না। স্বভাবতঃই গ্রামের আদিবাসীরা মেধা পাটকারের নেতৃত্বে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে; বাতাসে গর্জে ওঠে স্লোগান- ‘ডুবব কিন্তু ছাড়ব না’। ঝড় ওঠে শ্লোগানের—নয়া সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, প্রবল টেনশন ছড়িয়ে পড়ে। মেনীবেলী ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে । এক হাজারেরও অধিক সৈন্য পাঠিয়ে শুরু হয় রাষ্ট্ৰীয় তাণ্ডব- চলে মারধোর । গ্রেপ্তার হয় ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকার সমেত বহু নেতা ও অসংখ্য দরিদ্র আদিবাসী । পুড়িয়ে ফেলা হয় বহু বাড়ী। ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয় গ্রামের অধিকাংশ বাড়ী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বৃদ্ধির সাথে সাথে দাবানলের মত ছড়াতে থাকে আন্দোলনের আগুন। আন্দোলনের হাত শক্ত করতে অনশনে নামে আন্দোলনের নেতা শ্ৰীমথুরাভাই, মেধা পাটকার ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ । দীর্ঘ ১০ দিন অনশনরত অবস্থায় থাকলে অসুস্থতার দরুন মথুরাভাইকে হাসপাতালে ভৰ্ত্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাবা অামতে মধ্যপ্রদেশ-গুজরাট সীমান্তের ফারকুভায় ধরণা দিয়ে বসে থাকেন। সময়ের সাথে জোট বাঁধতে থাকে N.S.P ও S.S.P ছাড়াও অন্যান্য ( যথা সুবর্ণরেখা প্রকল্প প্রভৃতি ) প্রকল্পে আন্দোলনরত আদিবাসীরা। মোদ্দা কথা হল বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশ রক্ষার দাবিতে যে সব আন্দোলন চলছে "নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের” মধ্যে দিয়ে সে সব আন্দোলন জোটবদ্ধ হচ্ছে । এক ভয়ংকর যুদ্ধের আভাস আজ নর্মদার আকাশে বাতাসে। সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে প্রতিরোধের বাঁধ তৈরী হচ্ছে। প্রবল বিক্ষোভের চাপে বিশ্ব ব্যাংক তার সুতো গুটোতে বাধ্য হয়েছে । কিন্তু তা বলে স্বদেশী সরকারদের প্রবল জেদে ভরা প্রকল্পটির নির্মাণকাৰ্য স্থগিত থাকেনি। যেমন আছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তেমনই আছে প্রবল আন্দোলন।  
এই দেখুন, ভূমিকা করতে করতেই পাতা শেষ। এবার সত্যি কথাটা টুপ করে পেড়ে ফেলা যাক। অাসলে এ উপন্যাস আমার পক্ষে শেষ করা অসম্ভব। উপন্যাসটি কত জলদি পরিসমাপ্তির দিকে এগোবে তা নির্ভর করছে আমার আপনার মত অসংখ্য মানুষের শারীরীক বা মানসিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের উপর। তাই আসুন আমরা আরেক আরম্ভের জন্য লড়াই চালাই। শ্রেণীসংগ্রামের আগুন জ্বালিয়েই শেষ হোক দেশী বুর্জোয়া আমলা —সাম্রাজ্যবাদ আঁতাতের বাড়বাড়ন্ত বেলেল্লাপনা ।


No comments:

Post a Comment