বিমূর্ত শিল্পকলার ধারণা ও বাস্তবতা
শরীফ আতিক-উজ-জামান
বিমূর্ত ধারার আবির্ভাবের পূর্বেই চিত্রকলাকে রং ও গড়নের সম্মিলন বলে মনে করা হতো। সঙ্গীত ও স্থাপত্যকলাকে বিশুদ্ধ শিল্পের
দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হতো যা কোনো কিছুকে অনুকরণ করে সৃষ্ট নয়। রং ও গড়নের মাধ্যমে যে ছবি নির্মিত হয় তা আসলে কিছুই উপস্থাপন করে না―এই ধারণা তাৎক্ষণিকভাবে অনেকে মেনে নিতে পারেননি। যদি চারপাশের দৃশ্যমান বিষয়গুলোকে শুধু ফর্মের বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা হয় তাহলে নিশ্চিত শিল্পী ছবিতে তার বিকৃতি বা আকৃতির পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। শুধু ফর্মের গড়ন পাল্টে নান্দনিক মান সৃষ্টি করা যায় একদা তা ভাবনার অতীত ছিল। এই ফর্মগুলো যে সকল বস্তুর অন্তর্গত বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা ব্যক্তি বা স্থান, বাস্তব বা পৌরাণিক চরিত্র যা-ই হোক না কেন সেই সময়কে চিহ্নিত করে। শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির সামর্থ ও ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে তার ইতিহাস অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। বিমূর্ত শিল্পে বাহ্যিক উপস্থাপনার একটি মূল্য আছে। ক্যানভাসের ওপর নকশা ও নির্মাণের ক্ষেত্রে বস্তুর প্রকৃত আকার বা গঠন স্ব-কল্পিত গড়নের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, যে শিল্পীরা এই শিল্পের চর্চা করেন, কিন্তু বস্তুর দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ বা প্রকৃত আদল চিত্রায়নে মুন্সিয়ানার ছাপ রাখতে পারেন না তারাই দ্রুত বিমূর্তায়নকে স্বাগত জানান। এই বিষয়টির মধ্যে সত্য থাকলেও উল্লেখ করা জরুরি যে প্রচুর বাস্তব ও অবয়বধর্মী কাজ করার পরই সফল বিমূর্তায়ন সম্ভব হয়। এই নতুন শৈলী শিল্পীদের রং ও গড়নের প্রতি মনযোগী হতে শেখাল। আর তারা শিখলেন স্থান ও সময়কে অতিক্রম করতে। তাই তাদের পক্ষে দূরবর্তী কাল ও স্থানের শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহী হওয়া সম্ভব হলো। তারা এমন জিনিসের উপস্থাপনে আগ্রহী হলেন একদা যা ধারণাতীত ছিল। আদিম শিল্পের সাথে বস্তুর বিকৃত গঠন মিলিয়ে তারা যা সৃষ্টি করলেন তা সমালোচকরা শিল্পপদবাচ্য নয় বলে মন্তব্য করলেন। কিন্তু রাসকিন তার Political Economy of Art-এ আগেই মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর চিত্রকর্ম সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছিলেন। একদা যা ছিল কুৎসিত ও দানবিক তা হয়ে উঠল খাঁটি ও বিশুদ্ধ শিল্পকর্মের নিদর্শন। বিমূর্ত শিল্প বাস্তবানুগ আদল অগ্রাহ্য ও ইতিহাসের সীমানা অতিক্রমের মধ্য দিয়ে সর্বজনীন হতে পেরেছে। এর সাথে মুক্ত-জ্যামিতি তাকে এমন এক মাত্রা দিয়েছে যা ‘চিত্রকলা শুধুমাত্র দৃশ্যগ্রাহ্য বস্তুর অনুকৃতি’―এই ধারণাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তবে আজ বিমূর্তবাদী ও তাদের সহগামী পরাবাস্তববাদীরা বেশি বেশি করে বস্তুর সাথে সাদৃশ্য খুঁজছেন এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়ার সংকল্প থেকে খানিকটা হলেও সরে এসেছেন। তবে তার অর্থ এই নয় যে বিমূর্ত চিত্রকলার মৃত্যু হয়ে গেছে যা এর বিরুদ্ধবাদীরা গত দুই-তিন দশক ধরে দাবি করে আসছেন। তারা বলছেন যে এক মৌসুমে বড় এবং আরেক মৌসুমে ছোট স্কার্ট দেখে দেখে মানুষ যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি রং আর আকারের গঠন দেখে দেখে ক্লান্ত মানুষ আবার বস্তুর আদলের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। আর এর অর্থ হলো বিমূর্তায়নের মৃত্যু। তারা আরো যুক্তি দেখাচ্ছেন যে পিকাসো ও মন্ড্রিয়েন যা করেছেন তারপর বিমূর্ত শিল্পকলায় তরুণদের যোগ করার মতো খুব কম বৈশিষ্ট্যই অবশিষ্ট আছে। প্রতিটি নতুন মতবাদ চলমান মতবাদের প্রতিক্রিয়ারূপে সৃষ্টি হয়―এমন গৎবাঁধা ধারণা রয়েছে প্রতিটি শিল্পীর মনে। তাছাড়া নতুন ফর্মের স্রষ্টাদের সবসময়ই যুদ্ধ করতে হয়েছে সেইসব শিল্পীদের সাথে যারা পূর্বেকার সময়ের ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। বিগত সময়ের অনেক মতবাদের সৃষ্টি অন্য মতবাদের বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে, যেমন―গোথিকের বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে রেনেসাঁ এবং ম্যানারইজম ও রোকোকোর বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে যথাক্রমে ব্যারোক ও নিও-ক্লাসিসিজমের উৎপত্তি। কিন্তু নতুন মতবাদের উৎপত্তির এটাই একমাত্র কারণ নয়। একটি জাতির নিজস্ব-সত্তার মধ্যে নিহিত প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আবিষ্কারের প্রক্রিয়া হিসেবেও নতুন ধারা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও বড়সড় বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফল হিসেবে, স্বাধীনতা লাভ, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ অবসানের ফলে বা ভিনদেশী সাংস্কৃতিক উপাদানের মিশ্রণের ফলেও তা হতে পারে। ধ্রুপদী শিল্পধারার অধোগতির কারণ দেহসৌষ্ঠব চিত্রায়নের ওপর বেশিমাত্রায় গুরুত্ব প্রদান। একটি চলমান শিল্প মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া তখনই দৃশ্যমান হয় যখন নতুন মতবাদ খুব জোরালো হয় এবং পুরনো মতবাদ বা শিল্পধারা দুর্বল হয়ে পড়ে। যদি প্রভাববাদের মতো কোনো শিল্প মতবাদ বর্তমান সময়ের নিকটবর্তী ও ব্যাপকভাবে চর্চিত হয় তাহলে প্রতিক্রিয়ার ভিতর দিয়ে নতুন ধারা সৃষ্টির বিষয়টি খুব ধোপে টেকে না। প্রভাববাদের বিপরীতমুখি ধারা সৃষ্টি হতে হলে তা কতটা শিল্পী ও দর্শক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রভাববাদীদের যখন শুধুমাত্র সূর্যালোকের আলোকচিত্রী ও দানবীয় অবাস্তবতার স্রষ্টা হিসেবে আক্রমণ করা হলো তখন তাদের গুরুত্ব কমতে শুরু করল। পরবর্তীসময়ে কয়েকটি শিল্পগতিধারা বিভিন্ন দিক থেকে একসাথে এসে জড়ো হলো। কেউ কেউ একেবারে সরল প্রাকৃতিক গড়ন, কেউ আবার একেবারে আকারহীনতা নিয়ে হাজির হলেন যাকে প্রভাববাদের প্রতি এক ধরনের ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলল। এক দল প্রভাববাদ কর্তৃক বাতিলকৃত বস্তুনিচয়ের পুনঃসমাগম ঘটাতে লাগলেন। আরেকদল প্রকৃতির আদল তুলে ধরার ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লিখিত শিল্পীরা আমলে নেন নি তা ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হলেন। ১৮৮০ সালে প্রভাববাদের যে সব বেশিষ্ট্য এই প্রতিক্রিয়ার সূচনাকালীন প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল তার মাঝে ধ্রুপদী শিল্পীরা সুস্পষ্ট রৈখিক ফর্মের অভাব ও এক ধরনের অস্পষ্টতা দেখতে পেয়েছিলেন। সেই কারণে রেনোয়া প্রভাববাদ থেকে সরে এসেছিলেন বলে অনেকে মন্তব্য করে থাকেন। অন্য শিল্পীদের মতে প্রভাববাদ খানিকটা বিশৃঙ্খল ও পদ্ধতিহীন। আর নব্য-প্রভাববাদীরা পূর্বসূরীদের রং ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, তবে তা ধ্রুপদী ধারাকে সমর্থন না করলেও যথেষ্ট গঠনমূলক ও পরিকল্পিত ছিল। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে প্রভাববাদ অনেকটাই আলোকচিত্রধর্মী, অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু প্রতীকবাদীরা তাদের কাজে একধরনের জোরালো অনুভূতি ও নান্দনিক সক্রীয়তা তুলে ধরেন। ভিন্ন মতবাদের শিল্পীরা প্রভাববাদীদের অসংগঠিত বলে মনে করতেন। কিন্তু প্রভাববাদীরা যদি শিল্পীর অনুভূতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তাহলে তাদের উত্তরসূরীরা বিশেষ মানসিক অবস্থা এবং ভাব নির্মাণ ও প্রদর্শনের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলেন। ঐতিহাসিক সত্য হলো, ১৮৮০’র দশকে প্রভাববাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া তা এই শিল্পধারার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সম্ভাবনার আগেই এসে গিয়েছিল। একটি শিল্পকর্মে স্থায়ী ভাব (motif) ভিন্ন ভিন্ন রঙের বৈচিত্র্যে উপস্থাপন ১৮৯০’র দশকের বৈশিষ্ট্য। প্রভাববাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় প্রথমে ফ্রান্সে, পরে সমগ্র ইয়োরোপ জুড়ে। এই প্রতিক্রিয়া ছিল শিল্পীর জীবনের অভিজ্ঞতাজাত। ভ্যান গঘ ও গগ্যাঁ তাদের চিত্রকলায় নিজেদের সমাজ-বিচ্ছিন্নতাকে নানা বর্ণে তুলে ধরেছেন। গগ্যাঁর বন্ধুবলয়ে আরো শিল্পীরা ছিলেন যারা পরিণত সময়ে বুর্জোয়া সমাজের আশির্বাদ ছেড়েছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ১৮৮৫ সালের দিকে একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন এমন ভাবনাটাই অবাস্তব ছিল। তখন শিল্পীর স্বাধীনতা আর নৈতিক সততা ছাড়া কিছু ছিল না। প্রভাববাদ প্রকৃতিকে অনুভূতি-নির্ভর চিত্রকল্পের জন্য একটি ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে রূপান্তর করেছে। সেই সাথে অসুখি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুঁজিবাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে। প্রাথমিক দিকেও প্রভাববাদের একটি নৈতিক ভিত্তি ছিল। এর প্রথাহীন দৃশ্যকল্প, অবিরত পাল্টে যাওয়া বহিঃপ্রকৃতির অন্বেষণ বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে শহরকেন্দ্রিক যে স্বাচ্ছন্দ্য তা তখনকার চিত্রকলার বিষয় ও নান্দনিক ভাবনার মধ্যে সক্রীয় ছিল। শিল্পকে তারা একান্ত নিজস্ব নান্দনিক পরিতৃপ্তির বিষয় বলে মনে করতেন। সেখানে উদ্দেশ্য ও ধারণার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়নি। বুর্জোয়া সামাজিকীকরণের ধারণাটি সম্প্রদায়, পরিবার ও গীর্জা থেকে সরে এসে রাস্তা, বিশ্রামাগার ও ক্যাফে সর্বত্র বাণিজ্যিক আদলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত প্রভাববাদী শিল্পের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমঝদার ছিল না এবং নব্য-প্রভাববাদীরা দেহসৌষ্ঠবের বিশালতা ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। ১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকের ফরাসি শিল্পীরা প্রভাববাদীদের আক্রমণ করেছেন তার কাঠামো বা গড়নহীনতার জন্য। গগ্যাঁর ছবির যে সব জিজ্ঞাসাসূচক শিরোনাম, ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কে? আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ ইত্যাদি মনের বিশেষ এক অবস্থা। কিন্তু তাদের বিস্তর মানসিক অবস্থা ও নৈতিক নিরাপত্তাহীনতার পিছনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে সে সম্পর্কে শিল্পী খুব ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাই তারা একধরনের ধর্মসদৃশ বিশ্বাস বা কোনো আদিম বা সুশৃঙ্খল সমাজের প্রথা ও আদর্শকে তাদের সামগ্রিক আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য অপরিহার্য মনে করেছেন। মধ্য ও আদিম যুগের চিত্রকলার প্রতি তাদের যে আগ্রহ তা থেকেই তাদের Integral Nationalism-এর ধারণা তৈরি হয়েছিল। শিল্পীদের নিয়ে ভ্যান গঘের সঙ্ঘ তৈরির উদ্যোগ ছিল পুঁজিবাদ কর্তৃক ভেঙে দেওয়া মানুষের সামাজিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। তাদের Composition-এর তত্ত্ব খুবই প্রথাগত এবং প্রভাববাদীরা তা পরিত্যাগ করেছিলেন। বস্তুকে জড়ো করে কিছু রচনা করার প্রচেষ্টা যেমন প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান শৃঙ্খলার ধারণাজাত তেমন শিল্পীর মানসিক অবস্থা থেকেও উদ্ভুত, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই বস্তুর আকার বিকৃতিকরণ বিশেষ এক গুরুত্ব বহন করে। কেউ কেউ একখানা ক্যানভাস চান গীর্জার মতো সফেদ ও পবিত্র যেখানে সবকিছু দৃশ্যগ্রাহ্য, সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্নভাবে রঙে-রেখায় তুলে ধরা যায়। আবার অন্যরা রং ও রেখা ব্যতিরেকে জড় বা চলমান বস্তুর অর্থহীন অবস্থান নির্বাচন করেন। এই সমস্যাগুলো স্যুরাতের কাজে লক্ষ্য করা যায়, তবে সেই সমস্যা ভিন্নভাবে সমাধান করা হয়েছে। উপরে বর্ণিত চিত্রকলা ছাড়াও ফ্রান্সে ভিন্ন ধরনের চিত্রকলার প্রচলন ছিল। তবে শিল্পগতিধারার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে রক্ষণশীল ও শিক্ষায়তনিক ধারার শিল্পকলাও সময়ের আবর্তে পড়ে পাল্টে যায়। প্রভাববাদের বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়াসমূহ শিল্পী ও শিল্পরসিক উভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকেই উদ্ভূত যদিও অনেকে মনে করেন শিল্পের বিরুদ্ধবাদিতার বীজটি তার প্রকৃতির মাঝেই নিহিত থাকে। যদি প্রভাববাদ-পরবর্তী শিল্প নির্মাণের ঝোঁক চুড়ান্ত বিষয়ীকেন্দ্রিক ও বিমূর্ত-নির্ভর বলে সনাক্ত হয়ে থাকে তবে তার সূত্র প্রভাববাদের মাঝেই ছিল। মন ও প্রকৃতি এবং ব্যক্তি ও সমাজের নতুন আদর্শিক বিরুদ্ধবাদিতা সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ থেকে আগত যা প্রভাববাদের আগেও ছিল এবং আজকের দিনে তা অনেক বেশি প্রকট। ভ্যান গঘ বা গগ্যাঁর কাজে যে আর্তি, অস্থিরতা ও মূল্যবোধ সাম্প্রতিক কালের অজস্র শিল্পী সেই একই দ্বান্দ্বিক অবস্থা উপলব্ধি করছেন। বাস্তববাদী ও বিমূর্ত শিল্পকলার বিরুদ্ধে যে অবস্থান তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তা যথেষ্ট অশৈল্পিক। কিন্তু এর সমর্থক ও স্রষ্টারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেন। তাদের মতে এই শিল্প শর্তনিরপেক্ষভাবে নান্দনিক এবং শাশ্বত নিয়মের অনুসারী। বিমূর্ত চিত্রশিল্পী বাহ্যিক জগতের সরাসরি উপস্থাপনাকে অবজ্ঞা করেন, কারণ তা তাদের বিবেচনায় যথেষ্ট যান্ত্রিক এবং সেখানে শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতি ও কল্পনার কোনো জায়গা নেই। বিমূর্তায়ন বস্তুর অন্তর্নিহিত নির্যাস অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। দৃশ্যগ্রাহ্য বা অবয়বগত শিল্পকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দিলে সেখানে শুধু নিয়মতান্ত্রিক কিছু গড়ন দেখা যাবে, শিল্পীর কল্পনার কোনো ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। একটি বস্তুর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও নতুন অর্থ শুধুমাত্র বিমূর্তায়নের মাঝেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই বিমূর্ত প্রকাশভঙ্গি একান্তই ব্যক্তিগত। তবে এই মন্তব্য নিতান্তই একপেশে এবং উপস্থাপনের ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীন চিত্রকলায় পরিপ্রেক্ষিত, দেহসৌষ্ঠব, ছায়াসম্পাত ইত্যাদি ছিল প্রকাশের উপায়। সমস্ত চিত্রিত বিষয়াবলী, তা সে যতই বাস্তবানুগ হোক না কেন, এমনকি তা যদি আলোকচিত্রও হয়ে থাকে, তাকে মূল্যবোধ, পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আকার দেওয়া হতো এবং তা তার সারবস্তু তুলে ধরতো। অন্যদিকে অভিজ্ঞতার অতীত ‘বিশুদ্ধ শিল্প’ বলে আসলেই কিছু নেই। সমস্ত ফ্যান্টাসি, আনুষ্ঠানিক গড়ন ও হাতের অবিরাম আঁকিবুকি কোনোপ্রকার নান্দনিক জ্ঞান ছাড়া অভিজ্ঞতার আলোকেই হয়ে থাকে। প্রভাববাদীদের দৃষ্টান্ত থেকেই এই বিষয়টি পরিষ্কার। এগুলো আলোকচিত্র বা ফ্যান্টাসিধর্মী হতে পারে। রোমান্টিক ও ধ্রুপদী শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতির যে স্থায়ী সুর তাদের কাজে ছিল তা খুব প্রশংসিত হয়নি। প্রাচীনপন্থীরা বস্তুর সৌন্দর্যকে নিখুঁত করে তুলে ধরতে চাইতেন, আর বিমূর্ত শিল্পীরা তার কদর্যতাকে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধিতার ক্ষেত্রটি খুব প্রকট নয় বলেই অনেক সমালোচক মনে করেন। বাস্তববাদী ও বিমূর্ত ধারার শিল্পীরা নিজেদের মনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রথম দল দৃশ্যগ্রাহ্য জগৎকে পুনঃনির্মাণ করেন সঠিক পরিপ্রেক্ষিত, রূপরীতি ও রঙের সঠিক মাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে; আর দ্বিতীয় দল মনের খেয়ালে রং-রেখার মুক্তবিন্যাসে নতুন রূপরীতি প্রয়োগ করে দৃশ্যগ্রাহ্য বস্তুর নতুন এক আদল তৈরির মাধ্যমে। কিন্তু প্রকৃতির দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের চিত্রায়ন যেমন সৃষ্ট শিল্পকর্মের নান্দনিক মূল্যের নিশ্চয়তা দেয় না, তেমনি বিমূর্তায়নও বাস্তববাদ থেকে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। শুধু বলা চলে যে শিল্পধারার পরিবর্তন মানুষের রুচি ও ভাবনার পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে। শিল্প সমালোচক আলফ্রেড এইচ বার বিশ্বাস করেন যে দৃশ্যগ্রাহ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্প আবেগ, ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি যৌনানুভূতি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাস্তবানুগ রূপরীতির মাঝে নান্দনিক মূল্য রয়েছে, কিন্তু বিমূর্তায়নে সেই মূল্যের খুব একটা হেরফের হয় না। বিভিন্ন গড়ন, শূন্যস্থান, রং, রেখা, আলোছায়া ও প্রতিমা যা মানুষ বা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের আদলে নির্মিত হতো তা চিত্রকলা থেকে হারিয়ে গেল। একইসাথে বিমূর্ত চিত্রকলার নন্দনতত্ত্বের নতুন বৈশিষ্ট্য ওই বিষয়গুলোকে বাদ দিতে উৎসাহিত হলো যেগুলোর সাথে শিল্পীর মনের একটি যোগসূত্র রয়েছে।
বিমূর্ত চিত্রকলার কোনো অবিমিশ্র রূপরীতি নেই। বিভিন্ন ধরনের বিমূর্ত শিল্প নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের ওপর সাময়িক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, হতে পারে তা রং, উপরিতল, রূপরেখা অথবা কিছু আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি। তবে সবক্ষেত্রেই শিল্পীর আবেগ-নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্যান্ডিনেস্কি একটি প্রকাশভঙ্গি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন, তবে তা রক্ষণশীল এবং শিক্ষায়তনিক চিত্রকর্মের প্রকাশভঙ্গির মতোই। কিন্তু শিক্ষায়তনিক চিত্রকর্মের স্রষ্টারা রোমান্টিক চিত্রকলার প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন যেখানে বস্তু ভাবকে প্ররোচিত করে। যেমন, কোনো শিল্পী যদি নিসর্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো ভাব প্রকাশ করতে চান তাহলে তিনি সেই নিসর্গদৃশ্যটি আঁকবেন। কিন্তু ক্যান্ডিনেস্কি সম্পূর্ণরূপে সেই ভাবেরই একটি সমার্থক কাল্পনিক দৃশ্য নির্মাণ করতে চান। তিনি মনকে অতিক্রম করে যেতে চান না। একটি স্বাধীন কল্পনায় রং, গড়ন ও অবয়বের মাধ্যমে বস্তুকে উপস্থাপন করতে চান। প্রথম ক্ষেত্রে যে ভাব প্রকাশ পায় তা দ্বিতীয় ক্ষেত্রের ভাবের চেয়ে আলাদা। এই ভাব খুঁজে পাওয়া যায় অংশত চেনা বস্তুনিচয়ের মিলের মাঝে। বস্তুর সুস্পষ্ট আদল অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের সাথে সাথে একটি ভিন্নতর অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং আত্মসচেতনতা ও মনযোগ বৃদ্ধি করে। শিল্পী তার মনের সাথে তাল রেখে রং নির্বাচন করেন যা ক্যান্ডিনেস্কি করে এসেছেন। মনের ভিতর থেকে উঠে আসা আদল ও অন্তর্নিহিত ভাব দৃশ্যগ্রাহ্য পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। ভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুনিচয় বিকৃত রূপরীতির ভিতর দিয়ে বিমূর্ততায় আবির্ভূত হয়। অত্যন্ত সংবেদনশীল দর্শকও সেই প্রতিরূপের মাঝে নিজের অনুভূতির বিপরীত রূপ প্রত্যক্ষ করে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। প্রকৃতির দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের বিকৃতি উপস্থাপনের ভিতর দিয়ে শিল্পী নিঃসন্দেহে দৃশ্যগ্রাহ্য জগতের নিজস্ব একটি মূল্যায়ন তুলে ধরেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যসমূহ বাস্তব থেকে দূরবর্তী হলেও মনের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রধান বিষয়। জটিল পরিকল্পনাহীনতা, বুনট, রং, রেখা, এলোমেলো গড়ন, উপরিতল, ক্ষেত্রের মাঝে যে সাদৃশ্যহীনতা তা বিমূর্ত চিত্রশিল্পীদের একচ্ছত্র স্বাধীনতার বিষয়টি নির্দেশ করে। এটা আধুনিক চিত্রকলার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রেনেসাঁ শিল্পকলার যে পরিপ্রেক্ষিত ও রূপরীতি তা আজকের দিনে শুধুমাত্র অনুকৃতি হিসেবে মূল্য পাচ্ছে। কিন্তু রেনেসাঁ চিত্রকলার রৈখিক পরিপ্রেক্ষিত জগতের রহস্য উন্মোচনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি আজকের দিনে একজন বিমূর্ত চিত্রশিল্পীকে শিশু বা পাগলের মতো আঁকতে দেখা যায় তার মানে এই নয় যে তিনি ওই শ্রেণিভুক্ত। তিনি তার কাল্পনিক স্বাধীনতার একটা স্তরে রয়েছেন যেখান থেকে ওইরকম আঁকাই সম্ভব। এখানে তার ওপর কোনো বয়স্ক মানুষের দায়দায়িত্ব নেই। বিমূর্ত চিত্রকলায় শিল্পী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গড়ন বিকৃত বা অস্পষ্ট করে তোলেন। আদিম শিল্পপ্রসঙ্গ এই ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ শতকে বাস্তববাদী চিত্রকলার চর্চাকারীরা আদিম শিল্পের অলংকরণ পছন্দ করলেও তার উপস্থাপনাকে দানবীয় বলে মনে করতেন। কিন্তু বিমূর্ত চিত্রীরা আদিম চিত্রকলার জ্যামিতিক ধারার প্রতি উদাসীন ছিলেন। আধুনিক শিল্পে সুস্পষ্ট স্থায়ী সুর, সুশৃঙ্খল নকশা ও হস্তশিল্পের কারিগরি দিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। আদিম শিল্পের প্রতি এই সাড়া নান্দনিকতা থেকেও বেশি কিছু। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ এইসব আদিম বস্তুনিচয়ের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার কাজটি সহজ করলেও তাদের নান্দনিক আকাঙ্ক্ষা কম ছিল। যে প্রাচীন নৃতাত্ত্বিকেরা আদিম চিত্রকল্পের উপজাতীয় সূত্র অনুসন্ধান করেছেন তারা এই সৃষ্টির নান্দনিক ও বিষয়ীকেন্দ্রিক দিকটি উপেক্ষা করেছেন। এগুলো আদিম মানুষের সৃষ্টি কিন্তু কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। এখন তার আকর্ষণ গগনচুম্বী। সেগুলো সমাদর লাভ করছে সময়হীন ও সহজাত হওয়ার কারণে। সেখানে একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ ছাড়া অঙ্কনের দক্ষতা, পরিপাট্য, দিনক্ষণ বা স্বাক্ষর কিছুই নেই। সময় নিরপেক্ষ প্রাথমিক ও সহজাত শিল্প হিসেবে গুরুত্ব পাওয়ার সাথে সাথে তার নান্দনিক মূল্যও তৈরি হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এক ধরনের সাংস্কৃতিক নৈরাশ্যবাদ সৃষ্টি করায় শোষিত মানুষের শিল্প ইয়োরোপে খুব মর্যাদা পায়নি। উপনিবেশগুলো ছিল প্রতারণার ক্ষেত্র। তাই আদিম শিল্পের প্রতি নতুন করে সম্মান দেখানো প্রগতিশীলতা হলেও তখনকার দিনে পশ্চাৎপদ ও বর্বরদের সৃষ্ট শিল্প সংস্কৃতির মর্যাদা পায়নি। সেগুলো খুব মর্যাদাসম্পন্ন সৃষ্টি নয় বলেও প্রচলিত ছিল। আগেকার মানুষদের ব্যাপকভাবে নিধন ও দাসত্বে বাধ্য করার ফলে তাদের সংস্কৃতির প্রতি কারো তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি। তাছাড়া ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সংস্কৃতির বিশেষ কিছু রূপরীতির প্রতি আগ্রহও তাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল। আর তাই বিমূর্ত শিল্পধারাকে প্রকৃতির একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর অনুকরণের প্রতিক্রিয়ার ফসল কিংবা শিল্পের প্রচলিত ধারার বাইরে একেবারে নতুন রূপরীতি সৃষ্টির প্রচেষ্টাও বলা যেতে পারে। তবে বিমূর্ত শিল্পধারা খুব ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে নান্দনিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য সৃষ্টি হয়েছে এমন নয়। আধুনিক সংস্কৃতি ঘিরে থাকা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটি এখানে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিত্রসমালোচক আলফ্রেড এইচ বার বলেছেন যে বিমূর্তায়নের ক্ষেত্রে একটি অস্থিরতা ও আবেগজনিত উত্তেজনা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। শিল্পী নিজেকে নৈতিক ও অধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে প্রয়াসী হন। প্রকৃতির অবয়বগত বা দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের অনুকরণ অর্থহীন হলেও প্রকৃতি অর্থহীন ছিল না, তাই তার মূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল। শিল্পের দর্শনের সাথে জীবনের দর্শনের মিল আছে। Suprematism-এর প্রতিষ্ঠাতা রুশ চিত্রী কাজিমির মেলভিচ বলেছেন, ‘Suprematism বলতে আমি দৃশ্যগ্রাহ্য শিল্পের খাঁটি অনুভূতির কর্তৃত্ব বোঝাতে চেয়েছি... ১৯১৩ সালে বাহ্যিক জগতের ভার থেকে মরিয়া হয়ে শিল্পকে মুক্ত করতে যেয়ে আমি সাদা ক্ষেত্রের ওপর বর্গাকার গড়ন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। এটা কোনো শূন্য বর্গের স্তুপ ছিল না বরং ছিল বস্তুহীনতার অভিজ্ঞতা।’ পরবর্তী সময়ে ১৯১৮ সালে তিনি মস্কোতে সাদা ক্যানভাসের ওপর সাদা বর্গ নির্মাণ করে ধারাবাহিক চিত্রমালার এক প্রদর্শনী করেন। এই জ্যামিতিক শিল্পকলার মাঝে অনুভূতির বিশাল এক ভার লুকানো ছিল যার সাথে ধাতব শব্দ, বাতাসে ডানা মেলা ও অসীম শূন্যতার অনুভূতির যোগসূত্র ছিল। এই ধরনের ছবিকে খাঁটি বিমূর্তায়ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যা জ্যামিতিক রূপরীতি থেকে সৃষ্ট। ১৯১২ সালে আঁকা মেলভিচের Woman With Water Pails ছবিটিতে দেখা যায় জ্যামিতিক ফর্মে চিত্রায়িত কিষাণ রমণীর কাঁধে আড়াআড়িভাবে ধরা লাঠির দুই মাথায় দুটি পাত্র। এখানে ভারসাম্যই নান্দনিক পরিতৃপ্তির মৌলিক সূত্র। মানুষের বিষয়টি বিশেষ জ্যামিতিক বিমূর্তায়নের মাঝে হারিয়ে গেছে। পিকাসো কিউবিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ার আগে সার্কাসের অ্যাক্রোব্যাট, ভাঁড়, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, ভিক্ষুক প্রভৃতির ছবি আঁকতেন যারা ভারসাম্যের কসরত করছে। এই ফিগরগুলো সমাজের প্রান্তিক মানুষ যারা অন্যদের চোখে মূল্যহীন কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বিনোদন দিয়ে যায়। পিকাসোর এই বিমূর্তায়ন শিল্পকলার একটি বিশেষ ধাপ। মেলভিচ ইয়োরোপীয় শিল্পগতিধারার যে অকস্মাৎ পরিসমাপ্তি লক্ষ্য করেছিলেন এবং তা বোঝাতে সাদাক্ষেত্রের ওপর যেভাবে কালো বর্গ এঁকেছিলেন তাকে খুব মেনে নেওয়া যায় না বরং ক্যান্ডিনেস্কি যখন বলেন যে শিল্পী তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও স্বাধীনতার নিরিখে বিষয় ও নান্দনিক বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করবেন তা খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তবে তিনি অন্যদের মতো বলেননি যে বস্তুর অবিকল উপস্থাপনার গুরুত্ব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার চেতনার কাছে বস্তুতান্ত্রিক জগৎ দূরাগত এক বিভ্রম। তার শিল্প আধুনিক সমাজের বস্তুতান্ত্রিক ধারণার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ যার সাথে তিনি বিজ্ঞান ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে যুক্ত করেছেন। যখন ধর্ম, বিজ্ঞান ও নৈতিক ভাবনায় ধস নামে, বাইরের সমর্থন ভেঙে পড়ে তখন মানুষ বাইরের জগৎ থেকে নিজের ভিতরে দৃষ্টি ফেরায়। তিনি নিজের সময়ের অতীন্দ্রিয়বাদ, আদিম সময়ের আচার ইত্যাদি সম্মান করতেন। নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে তার মন্তব্যসমূহ তার দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধারণ করে। ‘তৃণভূমির সবুজ, হলুদ, লাল বৃক্ষ শুধুমাত্র বৃক্ষের দৈবিক বস্তুতান্ত্রিক রূপ যা আমরা বৃক্ষ শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে অনুভব করতে পারি।’ এবং নিজের প্রথম বিমূর্ত ছবি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সমস্ত উপস্থাপনা প্রধানত একটি ছবির বিশ্লেষণ যা আমি এঁকেছি অবচেতন মনে মানসিক অস্থিরতার মাঝে। আর তাই গভীরভাবে আমি এমন রূপরীতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি যা, আমার মনে পড়ছে, উচ্চস্বরে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছিল: প্রান্তগুলো ভারি হবে। দেখার পর দর্শক চিত্রিত বস্তু নয়, বরং ভাবটি অনুধাবন করবে।’ সমালোচক আলফ্রেড এইচ বার শিল্পী মেলভিচ ও ক্যান্ডিনেস্কির নৈতিক ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে গেলেও বার্গসঁ, নিৎসে এমনকি ফ্যাসিবাদের সাথে ইতালিয়ান শিল্পগতিধারার সম্পর্ককে অবহেলা করতে পারেননি, আর ভবিষ্যবাদের রূপরীতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে তারা এই বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছেন। তবে বারের মতে, ভবিষ্যবাদ কিছু আদর্শিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করলেও তা খাঁটি বিমূর্ত শিল্প নয়। এটাকে নিকট-বিমূর্ত শিল্প বলা যায়। তথাপি ‘খাঁটি’ বিমূর্ত শিল্পের রূপরীতি কিছু বস্তুগত গড়ন, বুনট ও আকারের মাধ্যমে এক ধরনের ভাব প্রকাশ করে যা শিল্পীর একান্ত নিজস্ব। এমন কি যান্ত্রিক বিমূর্ত রূপরীতিকে চলমান প্রযুক্তির প্রতিফলন হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। উনিশ শতকের মধ্যভাগে আধুনিক চিত্রকলায় যখন যন্ত্রের কদর বাড়তে লাগল তখন প্রগতিশীল শিল্পপতিদের রুচি বাস্তববাদী চিত্রকলার দিকে ধাবিত হতে লাগল। তখন কুরবেঁর চিত্রকলা প্রশংসিত হতে থাকল। একটি যান্ত্রিক বিমূর্ত রূপরীতির উদ্ভব দেখা গেল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রযুক্তিগত উন্নয়নে যারা বেশি এগিয়ে ছিল সেই আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের চিত্রশিল্পীরা যান্ত্রিক বিমূর্তায়নে রাশিয়া, ইতালি, হল্যান্ড ও ফ্রান্সের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। ঘনকবাদী, দাদাবাদী ও ভবিষ্যবাদী শিল্পীরা এই মাধ্যমে কাজ করেছেন। যান্ত্রিক বিমূর্তায়নের উদ্ভব হয়েছিল আধুনিক উৎপাদন যন্ত্রনির্ভর সেই কারণে নয়, মানুষ ও যন্ত্রের মাঝে একটি সাংঘর্ষিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হওয়ার ফলে। তাই যন্ত্রের নিরিখে মানুষের গুরুত্ব বেশি মাত্রায় অর্থনৈতিক। ইতালিয়ান লেখকেরা এটাকে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি ও অবসাদগ্রস্ততার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ বলে মনে করেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা শহুরে রুচির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তারা এই অবস্থাকে প্রগতিশীল ও আধুনিক হিসেবে গ্রহণ করলেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণি কর্তৃক প্রাদেশিক অভিজাত ঐতিহ্যকে আক্রমণ করার কারণ হলো প্রভাবশালী শ্রেণির স্বার্থের সাথে নিজেদের স্বার্থের ঐক্য আবিষ্কার। বিমূর্ত আদর্শ নিয়ে তৈরি হওয়া শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য শিল্পীদের মাঝেও সংক্রমিত হয়। যন্ত্রকে আধুনিক উৎপাদনের প্রাগ্রসর হাতিয়ার হিসেবে শিল্পীরা আগ্রহভরে গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার চেয়েও বড় কথা তারা যন্ত্রকে আধুনিক জীবনের গতিশীলতার উৎস হিসেবে দেখেছিলেন। যে শ্রমিকরা সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত তারা পদ্ধতিগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল আর যে শিল্পীরা জড়িত নন পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের বিমূর্ত ধারণা থেকে তারা সেই বিষয়কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ভবিষ্যবাদীরা আবার এই আন্দেলনকে আদর্শায়ন করলেন স্বাভাবিক গতিশীলতা হিসেবে যা বস্তুর রূপকে অস্পষ্ট ও ধ্বংস করে দেয়। একটি কার বা মোটর সাইকেলের গতিশীলতা, কেন্দ্রাতিগ চলন, বিশ পা নিয়ে কুকুরের ছুটে চলা, নাচের হল ইত্যাদি এই আন্দোলনের পরিচিত বিষয়বস্তু। ক্যানভাসের ক্ষেত্রটিতে অজস্র উজ্জ্বল আলোকরেখার সাথে শক্তির প্রকাশ হিসেবে অজস্র বস্তুর সাংঘর্ষিক অবস্থা দেখানো হয়েছে। প্রভাববাদীদের কাছে চলমানতা আয়েশি উপভোগের একটি মাধ্যম। আর ভবিষ্যবাদীদের কাছে এটা এক উন্মত্ততা যা যুদ্ধের পূর্বসংকেত। ভবিষ্যবাদীদের কিছু কিছু রূপরীতি ও বিমূর্ত চিত্রকলার কিছু বৈশিষ্ট্য ঘনকবাদ থেকে এসেছে। কিন্তু ইতালীয়রা ঘনকবাদকে দেখেছেন অতিমাত্রায় নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্পরীতি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যন্ত্রের উৎপাদন ক্ষমতা শিল্পীদের কাছে কিছু রূপরীতি ও বৃহত্তর প্রকাশবাদী চরিত্র নিয়ে হাজির হলো। প্রাচীন শিল্পকলাকে আধুনিক প্রযুক্তির ভাষায় ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল। নতুন সামগ্রীর সাথে বুনট ও অন্যান্য বিষয়, উপস্থাপনাকে আলোকচিত্র, ড্রইংকে রুলার দিয়ে টানা সরলরেখা, রংকে তুলির নীরস প্রলেপ এবং নকশাকে মডেল বা নির্দেশিত পরিকল্পনার সাথে তুলনা করা হতো। আধুনিক উৎপাদনের আরোপিত রূপরীতির সাথে শিল্পী প্রাচীন কর্মকাণ্ডের অপ্রয়োজনীয় বন্ধন তৈরি করতে চাইতেন। প্রযুক্তিকে তার অভ্যন্তরীণ সামর্থ্যসহ বিমূর্তরূপে স্বাধীন একটি শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এবং নকশাবিদ প্রকৌশলীই আধুনিক বিশ্বের স্রষ্টা। প্রথমদিকের প্রকাশবাদী বা ঘনকবাদীরা খানিকটা প্রযুক্তিনির্ভর শৈলীর অনুগত ছিলেন। এমনকি ক্যান্ডিনেস্কি ও মেলভিচ প্রযুক্তির প্রভাবে ১৯২০ শতকের দিকে বেশ খানিকটা পাল্টে গিয়েছিলেন। তারা স্থাপত্যকলা, ছাপচিত্র, নাট্যকলায় তাদের নকশা আরোপ করেছিলেন এবং তাদের কাজকে প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের কাজের বিপরীত নান্দনিক শিল্প হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন। তবে ভবিষ্যবাদীরা সংস্কৃতিকে পুনঃনির্মাণ করতে চেয়েছেন নতুন যুক্তি, কলাকৌশল ও নকশার মাধ্যমে। ওদের কেউ কেউ বলশেভিক বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন। অনেকে জার্মানি ও হল্যান্ডের সামাজিক গণতান্ত্রিক ও উদার স্থাপত্যকলাকে সমর্থন যুগিয়েছেন। তারপরও তাদের প্রগতিবাদের ধারণা বেশ উল্টোমুখি। শিল্পে আদর্শ হিসেবে প্রযুক্তির ধারণা আরোপিত, যা একদিকে যুদ্ধোত্তর ইয়োরোপের শিল্পবাস্তবতা, যেখানে আমেরিকার আধিপত্যবাদী পুঁজির হুমকিতে দম বন্ধ করা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, আর অন্যদিকে সংশোধনবাদী বিভ্রম, যা যুদ্ধোত্তরকালের অর্থনৈতিক স্থবিরতার মাঝে সংক্ষিপ্ত সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একটি প্রত্যাশা নিয়ে যে প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা আবাসনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য হ্রাসের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য কমিয়ে আনবে কিংবা যে কোনো উপায়ে প্রযুক্তিনির্ভর স্বভাব গড়ে তুলে একটি সফল অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের দিকে উত্তরণ ঘটাবে। ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় অনেক সমালোচক শিল্পীদের ছবি আঁকা ফেলে রেখে স্থপতি, প্রকৌশলী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন যদিও তারা এই অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ সম্পর্কে আদৌ অবগত ছিলেন না এবং স্থাপত্যশিল্পের নান্দনিক বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করেছিলেন। এই সংকটের সময় যান্ত্রিক বিমূর্ত শৈলী গৌণ হয়ে পড়ে। সেগুলো তরুণ শিল্পীদের ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। প্রতিবাস্তববাদী শৈলীর পরাবাস্তববাদ, যা দাদাবাদ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল, প্রধান্য লাভ করতে থাকে এবং নতুন রোমান্টিক শৈলী হিসেবে গণ্য হতে থাকে। শূন্য স্থান, উদ্ভট বস্তুনিচয়, পরিত্যাক্ত ঘরবাড়ি এবং ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর বিষণ্ন চিত্রকল্প এই শৈলীর সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে। আরো অনেক মতবাদ বিমূর্ত শিল্পকলার অন্তর্গত যা শিল্পকলাকে ঋদ্ধ করার সাথে সাথে জটিল ও প্রহেলিকাময় করেছে। তবে তাও শিল্পকলার বিশাল ঐতিহ্যেরই এক অংশ।
দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হতো যা কোনো কিছুকে অনুকরণ করে সৃষ্ট নয়। রং ও গড়নের মাধ্যমে যে ছবি নির্মিত হয় তা আসলে কিছুই উপস্থাপন করে না―এই ধারণা তাৎক্ষণিকভাবে অনেকে মেনে নিতে পারেননি। যদি চারপাশের দৃশ্যমান বিষয়গুলোকে শুধু ফর্মের বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা হয় তাহলে নিশ্চিত শিল্পী ছবিতে তার বিকৃতি বা আকৃতির পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। শুধু ফর্মের গড়ন পাল্টে নান্দনিক মান সৃষ্টি করা যায় একদা তা ভাবনার অতীত ছিল। এই ফর্মগুলো যে সকল বস্তুর অন্তর্গত বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা ব্যক্তি বা স্থান, বাস্তব বা পৌরাণিক চরিত্র যা-ই হোক না কেন সেই সময়কে চিহ্নিত করে। শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির সামর্থ ও ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে তার ইতিহাস অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। বিমূর্ত শিল্পে বাহ্যিক উপস্থাপনার একটি মূল্য আছে। ক্যানভাসের ওপর নকশা ও নির্মাণের ক্ষেত্রে বস্তুর প্রকৃত আকার বা গঠন স্ব-কল্পিত গড়নের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, যে শিল্পীরা এই শিল্পের চর্চা করেন, কিন্তু বস্তুর দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ বা প্রকৃত আদল চিত্রায়নে মুন্সিয়ানার ছাপ রাখতে পারেন না তারাই দ্রুত বিমূর্তায়নকে স্বাগত জানান। এই বিষয়টির মধ্যে সত্য থাকলেও উল্লেখ করা জরুরি যে প্রচুর বাস্তব ও অবয়বধর্মী কাজ করার পরই সফল বিমূর্তায়ন সম্ভব হয়। এই নতুন শৈলী শিল্পীদের রং ও গড়নের প্রতি মনযোগী হতে শেখাল। আর তারা শিখলেন স্থান ও সময়কে অতিক্রম করতে। তাই তাদের পক্ষে দূরবর্তী কাল ও স্থানের শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহী হওয়া সম্ভব হলো। তারা এমন জিনিসের উপস্থাপনে আগ্রহী হলেন একদা যা ধারণাতীত ছিল। আদিম শিল্পের সাথে বস্তুর বিকৃত গঠন মিলিয়ে তারা যা সৃষ্টি করলেন তা সমালোচকরা শিল্পপদবাচ্য নয় বলে মন্তব্য করলেন। কিন্তু রাসকিন তার Political Economy of Art-এ আগেই মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর চিত্রকর্ম সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছিলেন। একদা যা ছিল কুৎসিত ও দানবিক তা হয়ে উঠল খাঁটি ও বিশুদ্ধ শিল্পকর্মের নিদর্শন। বিমূর্ত শিল্প বাস্তবানুগ আদল অগ্রাহ্য ও ইতিহাসের সীমানা অতিক্রমের মধ্য দিয়ে সর্বজনীন হতে পেরেছে। এর সাথে মুক্ত-জ্যামিতি তাকে এমন এক মাত্রা দিয়েছে যা ‘চিত্রকলা শুধুমাত্র দৃশ্যগ্রাহ্য বস্তুর অনুকৃতি’―এই ধারণাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তবে আজ বিমূর্তবাদী ও তাদের সহগামী পরাবাস্তববাদীরা বেশি বেশি করে বস্তুর সাথে সাদৃশ্য খুঁজছেন এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়ার সংকল্প থেকে খানিকটা হলেও সরে এসেছেন। তবে তার অর্থ এই নয় যে বিমূর্ত চিত্রকলার মৃত্যু হয়ে গেছে যা এর বিরুদ্ধবাদীরা গত দুই-তিন দশক ধরে দাবি করে আসছেন। তারা বলছেন যে এক মৌসুমে বড় এবং আরেক মৌসুমে ছোট স্কার্ট দেখে দেখে মানুষ যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি রং আর আকারের গঠন দেখে দেখে ক্লান্ত মানুষ আবার বস্তুর আদলের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। আর এর অর্থ হলো বিমূর্তায়নের মৃত্যু। তারা আরো যুক্তি দেখাচ্ছেন যে পিকাসো ও মন্ড্রিয়েন যা করেছেন তারপর বিমূর্ত শিল্পকলায় তরুণদের যোগ করার মতো খুব কম বৈশিষ্ট্যই অবশিষ্ট আছে। প্রতিটি নতুন মতবাদ চলমান মতবাদের প্রতিক্রিয়ারূপে সৃষ্টি হয়―এমন গৎবাঁধা ধারণা রয়েছে প্রতিটি শিল্পীর মনে। তাছাড়া নতুন ফর্মের স্রষ্টাদের সবসময়ই যুদ্ধ করতে হয়েছে সেইসব শিল্পীদের সাথে যারা পূর্বেকার সময়ের ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। বিগত সময়ের অনেক মতবাদের সৃষ্টি অন্য মতবাদের বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে, যেমন―গোথিকের বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে রেনেসাঁ এবং ম্যানারইজম ও রোকোকোর বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে যথাক্রমে ব্যারোক ও নিও-ক্লাসিসিজমের উৎপত্তি। কিন্তু নতুন মতবাদের উৎপত্তির এটাই একমাত্র কারণ নয়। একটি জাতির নিজস্ব-সত্তার মধ্যে নিহিত প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আবিষ্কারের প্রক্রিয়া হিসেবেও নতুন ধারা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও বড়সড় বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফল হিসেবে, স্বাধীনতা লাভ, ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ অবসানের ফলে বা ভিনদেশী সাংস্কৃতিক উপাদানের মিশ্রণের ফলেও তা হতে পারে। ধ্রুপদী শিল্পধারার অধোগতির কারণ দেহসৌষ্ঠব চিত্রায়নের ওপর বেশিমাত্রায় গুরুত্ব প্রদান। একটি চলমান শিল্প মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া তখনই দৃশ্যমান হয় যখন নতুন মতবাদ খুব জোরালো হয় এবং পুরনো মতবাদ বা শিল্পধারা দুর্বল হয়ে পড়ে। যদি প্রভাববাদের মতো কোনো শিল্প মতবাদ বর্তমান সময়ের নিকটবর্তী ও ব্যাপকভাবে চর্চিত হয় তাহলে প্রতিক্রিয়ার ভিতর দিয়ে নতুন ধারা সৃষ্টির বিষয়টি খুব ধোপে টেকে না। প্রভাববাদের বিপরীতমুখি ধারা সৃষ্টি হতে হলে তা কতটা শিল্পী ও দর্শক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রভাববাদীদের যখন শুধুমাত্র সূর্যালোকের আলোকচিত্রী ও দানবীয় অবাস্তবতার স্রষ্টা হিসেবে আক্রমণ করা হলো তখন তাদের গুরুত্ব কমতে শুরু করল। পরবর্তীসময়ে কয়েকটি শিল্পগতিধারা বিভিন্ন দিক থেকে একসাথে এসে জড়ো হলো। কেউ কেউ একেবারে সরল প্রাকৃতিক গড়ন, কেউ আবার একেবারে আকারহীনতা নিয়ে হাজির হলেন যাকে প্রভাববাদের প্রতি এক ধরনের ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলল। এক দল প্রভাববাদ কর্তৃক বাতিলকৃত বস্তুনিচয়ের পুনঃসমাগম ঘটাতে লাগলেন। আরেকদল প্রকৃতির আদল তুলে ধরার ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লিখিত শিল্পীরা আমলে নেন নি তা ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হলেন। ১৮৮০ সালে প্রভাববাদের যে সব বেশিষ্ট্য এই প্রতিক্রিয়ার সূচনাকালীন প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল তার মাঝে ধ্রুপদী শিল্পীরা সুস্পষ্ট রৈখিক ফর্মের অভাব ও এক ধরনের অস্পষ্টতা দেখতে পেয়েছিলেন। সেই কারণে রেনোয়া প্রভাববাদ থেকে সরে এসেছিলেন বলে অনেকে মন্তব্য করে থাকেন। অন্য শিল্পীদের মতে প্রভাববাদ খানিকটা বিশৃঙ্খল ও পদ্ধতিহীন। আর নব্য-প্রভাববাদীরা পূর্বসূরীদের রং ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, তবে তা ধ্রুপদী ধারাকে সমর্থন না করলেও যথেষ্ট গঠনমূলক ও পরিকল্পিত ছিল। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে প্রভাববাদ অনেকটাই আলোকচিত্রধর্মী, অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু প্রতীকবাদীরা তাদের কাজে একধরনের জোরালো অনুভূতি ও নান্দনিক সক্রীয়তা তুলে ধরেন। ভিন্ন মতবাদের শিল্পীরা প্রভাববাদীদের অসংগঠিত বলে মনে করতেন। কিন্তু প্রভাববাদীরা যদি শিল্পীর অনুভূতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তাহলে তাদের উত্তরসূরীরা বিশেষ মানসিক অবস্থা এবং ভাব নির্মাণ ও প্রদর্শনের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলেন। ঐতিহাসিক সত্য হলো, ১৮৮০’র দশকে প্রভাববাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া তা এই শিল্পধারার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সম্ভাবনার আগেই এসে গিয়েছিল। একটি শিল্পকর্মে স্থায়ী ভাব (motif) ভিন্ন ভিন্ন রঙের বৈচিত্র্যে উপস্থাপন ১৮৯০’র দশকের বৈশিষ্ট্য। প্রভাববাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় প্রথমে ফ্রান্সে, পরে সমগ্র ইয়োরোপ জুড়ে। এই প্রতিক্রিয়া ছিল শিল্পীর জীবনের অভিজ্ঞতাজাত। ভ্যান গঘ ও গগ্যাঁ তাদের চিত্রকলায় নিজেদের সমাজ-বিচ্ছিন্নতাকে নানা বর্ণে তুলে ধরেছেন। গগ্যাঁর বন্ধুবলয়ে আরো শিল্পীরা ছিলেন যারা পরিণত সময়ে বুর্জোয়া সমাজের আশির্বাদ ছেড়েছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ১৮৮৫ সালের দিকে একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন এমন ভাবনাটাই অবাস্তব ছিল। তখন শিল্পীর স্বাধীনতা আর নৈতিক সততা ছাড়া কিছু ছিল না। প্রভাববাদ প্রকৃতিকে অনুভূতি-নির্ভর চিত্রকল্পের জন্য একটি ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে রূপান্তর করেছে। সেই সাথে অসুখি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুঁজিবাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে। প্রাথমিক দিকেও প্রভাববাদের একটি নৈতিক ভিত্তি ছিল। এর প্রথাহীন দৃশ্যকল্প, অবিরত পাল্টে যাওয়া বহিঃপ্রকৃতির অন্বেষণ বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে শহরকেন্দ্রিক যে স্বাচ্ছন্দ্য তা তখনকার চিত্রকলার বিষয় ও নান্দনিক ভাবনার মধ্যে সক্রীয় ছিল। শিল্পকে তারা একান্ত নিজস্ব নান্দনিক পরিতৃপ্তির বিষয় বলে মনে করতেন। সেখানে উদ্দেশ্য ও ধারণার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়নি। বুর্জোয়া সামাজিকীকরণের ধারণাটি সম্প্রদায়, পরিবার ও গীর্জা থেকে সরে এসে রাস্তা, বিশ্রামাগার ও ক্যাফে সর্বত্র বাণিজ্যিক আদলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত প্রভাববাদী শিল্পের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমঝদার ছিল না এবং নব্য-প্রভাববাদীরা দেহসৌষ্ঠবের বিশালতা ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। ১৮৮০ ও ১৮৯০-এর দশকের ফরাসি শিল্পীরা প্রভাববাদীদের আক্রমণ করেছেন তার কাঠামো বা গড়নহীনতার জন্য। গগ্যাঁর ছবির যে সব জিজ্ঞাসাসূচক শিরোনাম, ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কে? আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ ইত্যাদি মনের বিশেষ এক অবস্থা। কিন্তু তাদের বিস্তর মানসিক অবস্থা ও নৈতিক নিরাপত্তাহীনতার পিছনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে সে সম্পর্কে শিল্পী খুব ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাই তারা একধরনের ধর্মসদৃশ বিশ্বাস বা কোনো আদিম বা সুশৃঙ্খল সমাজের প্রথা ও আদর্শকে তাদের সামগ্রিক আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য অপরিহার্য মনে করেছেন। মধ্য ও আদিম যুগের চিত্রকলার প্রতি তাদের যে আগ্রহ তা থেকেই তাদের Integral Nationalism-এর ধারণা তৈরি হয়েছিল। শিল্পীদের নিয়ে ভ্যান গঘের সঙ্ঘ তৈরির উদ্যোগ ছিল পুঁজিবাদ কর্তৃক ভেঙে দেওয়া মানুষের সামাজিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। তাদের Composition-এর তত্ত্ব খুবই প্রথাগত এবং প্রভাববাদীরা তা পরিত্যাগ করেছিলেন। বস্তুকে জড়ো করে কিছু রচনা করার প্রচেষ্টা যেমন প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান শৃঙ্খলার ধারণাজাত তেমন শিল্পীর মানসিক অবস্থা থেকেও উদ্ভুত, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই বস্তুর আকার বিকৃতিকরণ বিশেষ এক গুরুত্ব বহন করে। কেউ কেউ একখানা ক্যানভাস চান গীর্জার মতো সফেদ ও পবিত্র যেখানে সবকিছু দৃশ্যগ্রাহ্য, সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্নভাবে রঙে-রেখায় তুলে ধরা যায়। আবার অন্যরা রং ও রেখা ব্যতিরেকে জড় বা চলমান বস্তুর অর্থহীন অবস্থান নির্বাচন করেন। এই সমস্যাগুলো স্যুরাতের কাজে লক্ষ্য করা যায়, তবে সেই সমস্যা ভিন্নভাবে সমাধান করা হয়েছে। উপরে বর্ণিত চিত্রকলা ছাড়াও ফ্রান্সে ভিন্ন ধরনের চিত্রকলার প্রচলন ছিল। তবে শিল্পগতিধারার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে রক্ষণশীল ও শিক্ষায়তনিক ধারার শিল্পকলাও সময়ের আবর্তে পড়ে পাল্টে যায়। প্রভাববাদের বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়াসমূহ শিল্পী ও শিল্পরসিক উভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকেই উদ্ভূত যদিও অনেকে মনে করেন শিল্পের বিরুদ্ধবাদিতার বীজটি তার প্রকৃতির মাঝেই নিহিত থাকে। যদি প্রভাববাদ-পরবর্তী শিল্প নির্মাণের ঝোঁক চুড়ান্ত বিষয়ীকেন্দ্রিক ও বিমূর্ত-নির্ভর বলে সনাক্ত হয়ে থাকে তবে তার সূত্র প্রভাববাদের মাঝেই ছিল। মন ও প্রকৃতি এবং ব্যক্তি ও সমাজের নতুন আদর্শিক বিরুদ্ধবাদিতা সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ থেকে আগত যা প্রভাববাদের আগেও ছিল এবং আজকের দিনে তা অনেক বেশি প্রকট। ভ্যান গঘ বা গগ্যাঁর কাজে যে আর্তি, অস্থিরতা ও মূল্যবোধ সাম্প্রতিক কালের অজস্র শিল্পী সেই একই দ্বান্দ্বিক অবস্থা উপলব্ধি করছেন। বাস্তববাদী ও বিমূর্ত শিল্পকলার বিরুদ্ধে যে অবস্থান তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তা যথেষ্ট অশৈল্পিক। কিন্তু এর সমর্থক ও স্রষ্টারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেন। তাদের মতে এই শিল্প শর্তনিরপেক্ষভাবে নান্দনিক এবং শাশ্বত নিয়মের অনুসারী। বিমূর্ত চিত্রশিল্পী বাহ্যিক জগতের সরাসরি উপস্থাপনাকে অবজ্ঞা করেন, কারণ তা তাদের বিবেচনায় যথেষ্ট যান্ত্রিক এবং সেখানে শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতি ও কল্পনার কোনো জায়গা নেই। বিমূর্তায়ন বস্তুর অন্তর্নিহিত নির্যাস অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। দৃশ্যগ্রাহ্য বা অবয়বগত শিল্পকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দিলে সেখানে শুধু নিয়মতান্ত্রিক কিছু গড়ন দেখা যাবে, শিল্পীর কল্পনার কোনো ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। একটি বস্তুর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও নতুন অর্থ শুধুমাত্র বিমূর্তায়নের মাঝেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই বিমূর্ত প্রকাশভঙ্গি একান্তই ব্যক্তিগত। তবে এই মন্তব্য নিতান্তই একপেশে এবং উপস্থাপনের ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীন চিত্রকলায় পরিপ্রেক্ষিত, দেহসৌষ্ঠব, ছায়াসম্পাত ইত্যাদি ছিল প্রকাশের উপায়। সমস্ত চিত্রিত বিষয়াবলী, তা সে যতই বাস্তবানুগ হোক না কেন, এমনকি তা যদি আলোকচিত্রও হয়ে থাকে, তাকে মূল্যবোধ, পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আকার দেওয়া হতো এবং তা তার সারবস্তু তুলে ধরতো। অন্যদিকে অভিজ্ঞতার অতীত ‘বিশুদ্ধ শিল্প’ বলে আসলেই কিছু নেই। সমস্ত ফ্যান্টাসি, আনুষ্ঠানিক গড়ন ও হাতের অবিরাম আঁকিবুকি কোনোপ্রকার নান্দনিক জ্ঞান ছাড়া অভিজ্ঞতার আলোকেই হয়ে থাকে। প্রভাববাদীদের দৃষ্টান্ত থেকেই এই বিষয়টি পরিষ্কার। এগুলো আলোকচিত্র বা ফ্যান্টাসিধর্মী হতে পারে। রোমান্টিক ও ধ্রুপদী শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতির যে স্থায়ী সুর তাদের কাজে ছিল তা খুব প্রশংসিত হয়নি। প্রাচীনপন্থীরা বস্তুর সৌন্দর্যকে নিখুঁত করে তুলে ধরতে চাইতেন, আর বিমূর্ত শিল্পীরা তার কদর্যতাকে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধিতার ক্ষেত্রটি খুব প্রকট নয় বলেই অনেক সমালোচক মনে করেন। বাস্তববাদী ও বিমূর্ত ধারার শিল্পীরা নিজেদের মনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রথম দল দৃশ্যগ্রাহ্য জগৎকে পুনঃনির্মাণ করেন সঠিক পরিপ্রেক্ষিত, রূপরীতি ও রঙের সঠিক মাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে; আর দ্বিতীয় দল মনের খেয়ালে রং-রেখার মুক্তবিন্যাসে নতুন রূপরীতি প্রয়োগ করে দৃশ্যগ্রাহ্য বস্তুর নতুন এক আদল তৈরির মাধ্যমে। কিন্তু প্রকৃতির দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের চিত্রায়ন যেমন সৃষ্ট শিল্পকর্মের নান্দনিক মূল্যের নিশ্চয়তা দেয় না, তেমনি বিমূর্তায়নও বাস্তববাদ থেকে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। শুধু বলা চলে যে শিল্পধারার পরিবর্তন মানুষের রুচি ও ভাবনার পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে। শিল্প সমালোচক আলফ্রেড এইচ বার বিশ্বাস করেন যে দৃশ্যগ্রাহ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্প আবেগ, ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি যৌনানুভূতি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাস্তবানুগ রূপরীতির মাঝে নান্দনিক মূল্য রয়েছে, কিন্তু বিমূর্তায়নে সেই মূল্যের খুব একটা হেরফের হয় না। বিভিন্ন গড়ন, শূন্যস্থান, রং, রেখা, আলোছায়া ও প্রতিমা যা মানুষ বা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের আদলে নির্মিত হতো তা চিত্রকলা থেকে হারিয়ে গেল। একইসাথে বিমূর্ত চিত্রকলার নন্দনতত্ত্বের নতুন বৈশিষ্ট্য ওই বিষয়গুলোকে বাদ দিতে উৎসাহিত হলো যেগুলোর সাথে শিল্পীর মনের একটি যোগসূত্র রয়েছে।
বিমূর্ত চিত্রকলার কোনো অবিমিশ্র রূপরীতি নেই। বিভিন্ন ধরনের বিমূর্ত শিল্প নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের ওপর সাময়িক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, হতে পারে তা রং, উপরিতল, রূপরেখা অথবা কিছু আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি। তবে সবক্ষেত্রেই শিল্পীর আবেগ-নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ক্যান্ডিনেস্কি একটি প্রকাশভঙ্গি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন, তবে তা রক্ষণশীল এবং শিক্ষায়তনিক চিত্রকর্মের প্রকাশভঙ্গির মতোই। কিন্তু শিক্ষায়তনিক চিত্রকর্মের স্রষ্টারা রোমান্টিক চিত্রকলার প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন যেখানে বস্তু ভাবকে প্ররোচিত করে। যেমন, কোনো শিল্পী যদি নিসর্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো ভাব প্রকাশ করতে চান তাহলে তিনি সেই নিসর্গদৃশ্যটি আঁকবেন। কিন্তু ক্যান্ডিনেস্কি সম্পূর্ণরূপে সেই ভাবেরই একটি সমার্থক কাল্পনিক দৃশ্য নির্মাণ করতে চান। তিনি মনকে অতিক্রম করে যেতে চান না। একটি স্বাধীন কল্পনায় রং, গড়ন ও অবয়বের মাধ্যমে বস্তুকে উপস্থাপন করতে চান। প্রথম ক্ষেত্রে যে ভাব প্রকাশ পায় তা দ্বিতীয় ক্ষেত্রের ভাবের চেয়ে আলাদা। এই ভাব খুঁজে পাওয়া যায় অংশত চেনা বস্তুনিচয়ের মিলের মাঝে। বস্তুর সুস্পষ্ট আদল অন্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের সাথে সাথে একটি ভিন্নতর অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং আত্মসচেতনতা ও মনযোগ বৃদ্ধি করে। শিল্পী তার মনের সাথে তাল রেখে রং নির্বাচন করেন যা ক্যান্ডিনেস্কি করে এসেছেন। মনের ভিতর থেকে উঠে আসা আদল ও অন্তর্নিহিত ভাব দৃশ্যগ্রাহ্য পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। ভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুনিচয় বিকৃত রূপরীতির ভিতর দিয়ে বিমূর্ততায় আবির্ভূত হয়। অত্যন্ত সংবেদনশীল দর্শকও সেই প্রতিরূপের মাঝে নিজের অনুভূতির বিপরীত রূপ প্রত্যক্ষ করে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। প্রকৃতির দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের বিকৃতি উপস্থাপনের ভিতর দিয়ে শিল্পী নিঃসন্দেহে দৃশ্যগ্রাহ্য জগতের নিজস্ব একটি মূল্যায়ন তুলে ধরেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যসমূহ বাস্তব থেকে দূরবর্তী হলেও মনের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রধান বিষয়। জটিল পরিকল্পনাহীনতা, বুনট, রং, রেখা, এলোমেলো গড়ন, উপরিতল, ক্ষেত্রের মাঝে যে সাদৃশ্যহীনতা তা বিমূর্ত চিত্রশিল্পীদের একচ্ছত্র স্বাধীনতার বিষয়টি নির্দেশ করে। এটা আধুনিক চিত্রকলার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রেনেসাঁ শিল্পকলার যে পরিপ্রেক্ষিত ও রূপরীতি তা আজকের দিনে শুধুমাত্র অনুকৃতি হিসেবে মূল্য পাচ্ছে। কিন্তু রেনেসাঁ চিত্রকলার রৈখিক পরিপ্রেক্ষিত জগতের রহস্য উন্মোচনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি আজকের দিনে একজন বিমূর্ত চিত্রশিল্পীকে শিশু বা পাগলের মতো আঁকতে দেখা যায় তার মানে এই নয় যে তিনি ওই শ্রেণিভুক্ত। তিনি তার কাল্পনিক স্বাধীনতার একটা স্তরে রয়েছেন যেখান থেকে ওইরকম আঁকাই সম্ভব। এখানে তার ওপর কোনো বয়স্ক মানুষের দায়দায়িত্ব নেই। বিমূর্ত চিত্রকলায় শিল্পী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গড়ন বিকৃত বা অস্পষ্ট করে তোলেন। আদিম শিল্পপ্রসঙ্গ এই ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ শতকে বাস্তববাদী চিত্রকলার চর্চাকারীরা আদিম শিল্পের অলংকরণ পছন্দ করলেও তার উপস্থাপনাকে দানবীয় বলে মনে করতেন। কিন্তু বিমূর্ত চিত্রীরা আদিম চিত্রকলার জ্যামিতিক ধারার প্রতি উদাসীন ছিলেন। আধুনিক শিল্পে সুস্পষ্ট স্থায়ী সুর, সুশৃঙ্খল নকশা ও হস্তশিল্পের কারিগরি দিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। আদিম শিল্পের প্রতি এই সাড়া নান্দনিকতা থেকেও বেশি কিছু। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ এইসব আদিম বস্তুনিচয়ের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার কাজটি সহজ করলেও তাদের নান্দনিক আকাঙ্ক্ষা কম ছিল। যে প্রাচীন নৃতাত্ত্বিকেরা আদিম চিত্রকল্পের উপজাতীয় সূত্র অনুসন্ধান করেছেন তারা এই সৃষ্টির নান্দনিক ও বিষয়ীকেন্দ্রিক দিকটি উপেক্ষা করেছেন। এগুলো আদিম মানুষের সৃষ্টি কিন্তু কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। এখন তার আকর্ষণ গগনচুম্বী। সেগুলো সমাদর লাভ করছে সময়হীন ও সহজাত হওয়ার কারণে। সেখানে একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ ছাড়া অঙ্কনের দক্ষতা, পরিপাট্য, দিনক্ষণ বা স্বাক্ষর কিছুই নেই। সময় নিরপেক্ষ প্রাথমিক ও সহজাত শিল্প হিসেবে গুরুত্ব পাওয়ার সাথে সাথে তার নান্দনিক মূল্যও তৈরি হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এক ধরনের সাংস্কৃতিক নৈরাশ্যবাদ সৃষ্টি করায় শোষিত মানুষের শিল্প ইয়োরোপে খুব মর্যাদা পায়নি। উপনিবেশগুলো ছিল প্রতারণার ক্ষেত্র। তাই আদিম শিল্পের প্রতি নতুন করে সম্মান দেখানো প্রগতিশীলতা হলেও তখনকার দিনে পশ্চাৎপদ ও বর্বরদের সৃষ্ট শিল্প সংস্কৃতির মর্যাদা পায়নি। সেগুলো খুব মর্যাদাসম্পন্ন সৃষ্টি নয় বলেও প্রচলিত ছিল। আগেকার মানুষদের ব্যাপকভাবে নিধন ও দাসত্বে বাধ্য করার ফলে তাদের সংস্কৃতির প্রতি কারো তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি। তাছাড়া ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সংস্কৃতির বিশেষ কিছু রূপরীতির প্রতি আগ্রহও তাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল। আর তাই বিমূর্ত শিল্পধারাকে প্রকৃতির একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর অনুকরণের প্রতিক্রিয়ার ফসল কিংবা শিল্পের প্রচলিত ধারার বাইরে একেবারে নতুন রূপরীতি সৃষ্টির প্রচেষ্টাও বলা যেতে পারে। তবে বিমূর্ত শিল্পধারা খুব ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে নান্দনিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য সৃষ্টি হয়েছে এমন নয়। আধুনিক সংস্কৃতি ঘিরে থাকা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটি এখানে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিত্রসমালোচক আলফ্রেড এইচ বার বলেছেন যে বিমূর্তায়নের ক্ষেত্রে একটি অস্থিরতা ও আবেগজনিত উত্তেজনা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। শিল্পী নিজেকে নৈতিক ও অধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে প্রয়াসী হন। প্রকৃতির অবয়বগত বা দৃশ্যগ্রাহ্য রূপের অনুকরণ অর্থহীন হলেও প্রকৃতি অর্থহীন ছিল না, তাই তার মূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল। শিল্পের দর্শনের সাথে জীবনের দর্শনের মিল আছে। Suprematism-এর প্রতিষ্ঠাতা রুশ চিত্রী কাজিমির মেলভিচ বলেছেন, ‘Suprematism বলতে আমি দৃশ্যগ্রাহ্য শিল্পের খাঁটি অনুভূতির কর্তৃত্ব বোঝাতে চেয়েছি... ১৯১৩ সালে বাহ্যিক জগতের ভার থেকে মরিয়া হয়ে শিল্পকে মুক্ত করতে যেয়ে আমি সাদা ক্ষেত্রের ওপর বর্গাকার গড়ন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। এটা কোনো শূন্য বর্গের স্তুপ ছিল না বরং ছিল বস্তুহীনতার অভিজ্ঞতা।’ পরবর্তী সময়ে ১৯১৮ সালে তিনি মস্কোতে সাদা ক্যানভাসের ওপর সাদা বর্গ নির্মাণ করে ধারাবাহিক চিত্রমালার এক প্রদর্শনী করেন। এই জ্যামিতিক শিল্পকলার মাঝে অনুভূতির বিশাল এক ভার লুকানো ছিল যার সাথে ধাতব শব্দ, বাতাসে ডানা মেলা ও অসীম শূন্যতার অনুভূতির যোগসূত্র ছিল। এই ধরনের ছবিকে খাঁটি বিমূর্তায়ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যা জ্যামিতিক রূপরীতি থেকে সৃষ্ট। ১৯১২ সালে আঁকা মেলভিচের Woman With Water Pails ছবিটিতে দেখা যায় জ্যামিতিক ফর্মে চিত্রায়িত কিষাণ রমণীর কাঁধে আড়াআড়িভাবে ধরা লাঠির দুই মাথায় দুটি পাত্র। এখানে ভারসাম্যই নান্দনিক পরিতৃপ্তির মৌলিক সূত্র। মানুষের বিষয়টি বিশেষ জ্যামিতিক বিমূর্তায়নের মাঝে হারিয়ে গেছে। পিকাসো কিউবিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ার আগে সার্কাসের অ্যাক্রোব্যাট, ভাঁড়, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, ভিক্ষুক প্রভৃতির ছবি আঁকতেন যারা ভারসাম্যের কসরত করছে। এই ফিগরগুলো সমাজের প্রান্তিক মানুষ যারা অন্যদের চোখে মূল্যহীন কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বিনোদন দিয়ে যায়। পিকাসোর এই বিমূর্তায়ন শিল্পকলার একটি বিশেষ ধাপ। মেলভিচ ইয়োরোপীয় শিল্পগতিধারার যে অকস্মাৎ পরিসমাপ্তি লক্ষ্য করেছিলেন এবং তা বোঝাতে সাদাক্ষেত্রের ওপর যেভাবে কালো বর্গ এঁকেছিলেন তাকে খুব মেনে নেওয়া যায় না বরং ক্যান্ডিনেস্কি যখন বলেন যে শিল্পী তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও স্বাধীনতার নিরিখে বিষয় ও নান্দনিক বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করবেন তা খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তবে তিনি অন্যদের মতো বলেননি যে বস্তুর অবিকল উপস্থাপনার গুরুত্ব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার চেতনার কাছে বস্তুতান্ত্রিক জগৎ দূরাগত এক বিভ্রম। তার শিল্প আধুনিক সমাজের বস্তুতান্ত্রিক ধারণার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ যার সাথে তিনি বিজ্ঞান ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে যুক্ত করেছেন। যখন ধর্ম, বিজ্ঞান ও নৈতিক ভাবনায় ধস নামে, বাইরের সমর্থন ভেঙে পড়ে তখন মানুষ বাইরের জগৎ থেকে নিজের ভিতরে দৃষ্টি ফেরায়। তিনি নিজের সময়ের অতীন্দ্রিয়বাদ, আদিম সময়ের আচার ইত্যাদি সম্মান করতেন। নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে তার মন্তব্যসমূহ তার দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধারণ করে। ‘তৃণভূমির সবুজ, হলুদ, লাল বৃক্ষ শুধুমাত্র বৃক্ষের দৈবিক বস্তুতান্ত্রিক রূপ যা আমরা বৃক্ষ শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে অনুভব করতে পারি।’ এবং নিজের প্রথম বিমূর্ত ছবি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সমস্ত উপস্থাপনা প্রধানত একটি ছবির বিশ্লেষণ যা আমি এঁকেছি অবচেতন মনে মানসিক অস্থিরতার মাঝে। আর তাই গভীরভাবে আমি এমন রূপরীতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি যা, আমার মনে পড়ছে, উচ্চস্বরে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছিল: প্রান্তগুলো ভারি হবে। দেখার পর দর্শক চিত্রিত বস্তু নয়, বরং ভাবটি অনুধাবন করবে।’ সমালোচক আলফ্রেড এইচ বার শিল্পী মেলভিচ ও ক্যান্ডিনেস্কির নৈতিক ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে গেলেও বার্গসঁ, নিৎসে এমনকি ফ্যাসিবাদের সাথে ইতালিয়ান শিল্পগতিধারার সম্পর্ককে অবহেলা করতে পারেননি, আর ভবিষ্যবাদের রূপরীতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে তারা এই বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছেন। তবে বারের মতে, ভবিষ্যবাদ কিছু আদর্শিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করলেও তা খাঁটি বিমূর্ত শিল্প নয়। এটাকে নিকট-বিমূর্ত শিল্প বলা যায়। তথাপি ‘খাঁটি’ বিমূর্ত শিল্পের রূপরীতি কিছু বস্তুগত গড়ন, বুনট ও আকারের মাধ্যমে এক ধরনের ভাব প্রকাশ করে যা শিল্পীর একান্ত নিজস্ব। এমন কি যান্ত্রিক বিমূর্ত রূপরীতিকে চলমান প্রযুক্তির প্রতিফলন হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। উনিশ শতকের মধ্যভাগে আধুনিক চিত্রকলায় যখন যন্ত্রের কদর বাড়তে লাগল তখন প্রগতিশীল শিল্পপতিদের রুচি বাস্তববাদী চিত্রকলার দিকে ধাবিত হতে লাগল। তখন কুরবেঁর চিত্রকলা প্রশংসিত হতে থাকল। একটি যান্ত্রিক বিমূর্ত রূপরীতির উদ্ভব দেখা গেল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রযুক্তিগত উন্নয়নে যারা বেশি এগিয়ে ছিল সেই আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের চিত্রশিল্পীরা যান্ত্রিক বিমূর্তায়নে রাশিয়া, ইতালি, হল্যান্ড ও ফ্রান্সের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। ঘনকবাদী, দাদাবাদী ও ভবিষ্যবাদী শিল্পীরা এই মাধ্যমে কাজ করেছেন। যান্ত্রিক বিমূর্তায়নের উদ্ভব হয়েছিল আধুনিক উৎপাদন যন্ত্রনির্ভর সেই কারণে নয়, মানুষ ও যন্ত্রের মাঝে একটি সাংঘর্ষিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হওয়ার ফলে। তাই যন্ত্রের নিরিখে মানুষের গুরুত্ব বেশি মাত্রায় অর্থনৈতিক। ইতালিয়ান লেখকেরা এটাকে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি ও অবসাদগ্রস্ততার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ বলে মনে করেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা শহুরে রুচির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তারা এই অবস্থাকে প্রগতিশীল ও আধুনিক হিসেবে গ্রহণ করলেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণি কর্তৃক প্রাদেশিক অভিজাত ঐতিহ্যকে আক্রমণ করার কারণ হলো প্রভাবশালী শ্রেণির স্বার্থের সাথে নিজেদের স্বার্থের ঐক্য আবিষ্কার। বিমূর্ত আদর্শ নিয়ে তৈরি হওয়া শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য শিল্পীদের মাঝেও সংক্রমিত হয়। যন্ত্রকে আধুনিক উৎপাদনের প্রাগ্রসর হাতিয়ার হিসেবে শিল্পীরা আগ্রহভরে গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার চেয়েও বড় কথা তারা যন্ত্রকে আধুনিক জীবনের গতিশীলতার উৎস হিসেবে দেখেছিলেন। যে শ্রমিকরা সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত তারা পদ্ধতিগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল আর যে শিল্পীরা জড়িত নন পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের বিমূর্ত ধারণা থেকে তারা সেই বিষয়কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ভবিষ্যবাদীরা আবার এই আন্দেলনকে আদর্শায়ন করলেন স্বাভাবিক গতিশীলতা হিসেবে যা বস্তুর রূপকে অস্পষ্ট ও ধ্বংস করে দেয়। একটি কার বা মোটর সাইকেলের গতিশীলতা, কেন্দ্রাতিগ চলন, বিশ পা নিয়ে কুকুরের ছুটে চলা, নাচের হল ইত্যাদি এই আন্দোলনের পরিচিত বিষয়বস্তু। ক্যানভাসের ক্ষেত্রটিতে অজস্র উজ্জ্বল আলোকরেখার সাথে শক্তির প্রকাশ হিসেবে অজস্র বস্তুর সাংঘর্ষিক অবস্থা দেখানো হয়েছে। প্রভাববাদীদের কাছে চলমানতা আয়েশি উপভোগের একটি মাধ্যম। আর ভবিষ্যবাদীদের কাছে এটা এক উন্মত্ততা যা যুদ্ধের পূর্বসংকেত। ভবিষ্যবাদীদের কিছু কিছু রূপরীতি ও বিমূর্ত চিত্রকলার কিছু বৈশিষ্ট্য ঘনকবাদ থেকে এসেছে। কিন্তু ইতালীয়রা ঘনকবাদকে দেখেছেন অতিমাত্রায় নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্পরীতি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যন্ত্রের উৎপাদন ক্ষমতা শিল্পীদের কাছে কিছু রূপরীতি ও বৃহত্তর প্রকাশবাদী চরিত্র নিয়ে হাজির হলো। প্রাচীন শিল্পকলাকে আধুনিক প্রযুক্তির ভাষায় ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল। নতুন সামগ্রীর সাথে বুনট ও অন্যান্য বিষয়, উপস্থাপনাকে আলোকচিত্র, ড্রইংকে রুলার দিয়ে টানা সরলরেখা, রংকে তুলির নীরস প্রলেপ এবং নকশাকে মডেল বা নির্দেশিত পরিকল্পনার সাথে তুলনা করা হতো। আধুনিক উৎপাদনের আরোপিত রূপরীতির সাথে শিল্পী প্রাচীন কর্মকাণ্ডের অপ্রয়োজনীয় বন্ধন তৈরি করতে চাইতেন। প্রযুক্তিকে তার অভ্যন্তরীণ সামর্থ্যসহ বিমূর্তরূপে স্বাধীন একটি শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এবং নকশাবিদ প্রকৌশলীই আধুনিক বিশ্বের স্রষ্টা। প্রথমদিকের প্রকাশবাদী বা ঘনকবাদীরা খানিকটা প্রযুক্তিনির্ভর শৈলীর অনুগত ছিলেন। এমনকি ক্যান্ডিনেস্কি ও মেলভিচ প্রযুক্তির প্রভাবে ১৯২০ শতকের দিকে বেশ খানিকটা পাল্টে গিয়েছিলেন। তারা স্থাপত্যকলা, ছাপচিত্র, নাট্যকলায় তাদের নকশা আরোপ করেছিলেন এবং তাদের কাজকে প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের কাজের বিপরীত নান্দনিক শিল্প হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন। তবে ভবিষ্যবাদীরা সংস্কৃতিকে পুনঃনির্মাণ করতে চেয়েছেন নতুন যুক্তি, কলাকৌশল ও নকশার মাধ্যমে। ওদের কেউ কেউ বলশেভিক বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন। অনেকে জার্মানি ও হল্যান্ডের সামাজিক গণতান্ত্রিক ও উদার স্থাপত্যকলাকে সমর্থন যুগিয়েছেন। তারপরও তাদের প্রগতিবাদের ধারণা বেশ উল্টোমুখি। শিল্পে আদর্শ হিসেবে প্রযুক্তির ধারণা আরোপিত, যা একদিকে যুদ্ধোত্তর ইয়োরোপের শিল্পবাস্তবতা, যেখানে আমেরিকার আধিপত্যবাদী পুঁজির হুমকিতে দম বন্ধ করা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, আর অন্যদিকে সংশোধনবাদী বিভ্রম, যা যুদ্ধোত্তরকালের অর্থনৈতিক স্থবিরতার মাঝে সংক্ষিপ্ত সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একটি প্রত্যাশা নিয়ে যে প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা আবাসনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য হ্রাসের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য কমিয়ে আনবে কিংবা যে কোনো উপায়ে প্রযুক্তিনির্ভর স্বভাব গড়ে তুলে একটি সফল অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের দিকে উত্তরণ ঘটাবে। ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় অনেক সমালোচক শিল্পীদের ছবি আঁকা ফেলে রেখে স্থপতি, প্রকৌশলী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন যদিও তারা এই অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ সম্পর্কে আদৌ অবগত ছিলেন না এবং স্থাপত্যশিল্পের নান্দনিক বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করেছিলেন। এই সংকটের সময় যান্ত্রিক বিমূর্ত শৈলী গৌণ হয়ে পড়ে। সেগুলো তরুণ শিল্পীদের ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। প্রতিবাস্তববাদী শৈলীর পরাবাস্তববাদ, যা দাদাবাদ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল, প্রধান্য লাভ করতে থাকে এবং নতুন রোমান্টিক শৈলী হিসেবে গণ্য হতে থাকে। শূন্য স্থান, উদ্ভট বস্তুনিচয়, পরিত্যাক্ত ঘরবাড়ি এবং ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর বিষণ্ন চিত্রকল্প এই শৈলীর সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে। আরো অনেক মতবাদ বিমূর্ত শিল্পকলার অন্তর্গত যা শিল্পকলাকে ঋদ্ধ করার সাথে সাথে জটিল ও প্রহেলিকাময় করেছে। তবে তাও শিল্পকলার বিশাল ঐতিহ্যেরই এক অংশ।
No comments:
Post a Comment