Sunday, 31 May 2015

লু স্যুনের গল্প : জ্ঞানী, বোকা এবং ক্রীতদাস : অনুবাদ - সুদেষ্ণা মিত্র

লু স্যুনের গল্প : জ্ঞানী, বোকা এবং ক্রীতদাস

অনুবাদ : সুদেষ্ণা মিত্র


( লেখক পরিচিতি :  লু স্যুন ( ১৮৮১-১৯৩৬) , সমসাময়িক চৈনিক সাহিত্যের একজন সম্পদশীল প্রতিভা। তিনি কেবলমাত্র একজন সুলেখকই নন, একজন উল্লেখযোগ্য বিপ্লবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। কলমকে অস্ত্র করে তিনি এক কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যান সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র এবং আমলাতান্ত্রিক পুজিবাদের বিরুদ্ধে। তিনি তার একমাত্র জীবনে বহু ছোটগল্প, প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি প্রধানতঃ ঘু্নধরা সমাজ ব্যবস্থার সঠিক চিত্রটিকে তার অসামান্য গল্পগুলির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। এই বিশেষ গল্পটি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । )


জ্ঞানী, বোকা এবং ক্রীতদাস




এক ছিল ক্রীতদাস, সে কোন কাজই করেনা, কিন্তু সেই ধরণের মানুষজন খুঁজে বেড়ায় যাদের সে তার দুঃখ- দুর্দশা কথা প্রকাশ করতে পারে। একদিন এক জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা হল ।
“ প্রভু !” বিষাদের সঙ্গে সে ডাকলো, তার চোখে জলের ধারা ।
“আপনি জানেন, আমি এক কুকুরের জীবনযাপন করি। অনেক সময় আমার সমস্ত দিন খাবার জোটেনা । যদি জোটে তা শুয়োরের খাদ্যের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট নয়। এমনকি তার পরিমাণ এক ছোট পাত্রের সমানও বলা যাবেনা...”
       “ব্যাপারটা সত্যিই খুব খারাপ,” জ্ঞানী ব্যক্তিটি সহানুভূতির সঙ্গে বললেন ।
       “ব্যাপারটা ঠিক এইরকম, নয় কি?” তার অন্তর্নিহিত শক্তিগুলো জেগে উঠলো।“আমি সমস্ত দিন এবং সমস্ত রাত্রি যাবৎ কাজ করি। ভোরবেলা জল তুলে আনি, রাত্রে রান্না করি সকালবেলা আদেশ পালন করার তাগিদে দৌড়োই, সন্ধ্যেবেলায় শস্যপেষণ করি সব হয়ে গেলে মনিবের জামাকাপড় কাচি, যখন তা ভিজে যায় ছাতা ধরি , শীতে আমার আগুন পোহাতে ভালো লাগে! গরমে পাখার বাতাসকে উপভোগ করতে ভালো লাগে ! মধ্যরাতে সাদা শ্যাওলা সেদ্ধ করতে হয় এবং মনিবের স্ফূর্তি শেষে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় কিন্তু কখনও একটা পয়সা আমার জোটেনা কেবলমাত্র কখনও কখনও চামড়ার লম্বা,সরু, তীক্ষ্ণ ফলাটা ……...।”
        জ্ঞানী ব্যক্তিটির চোখের প্রান্ত দুটাে লাল হয়ে উঠলো, যেন তার চোখে এক্ষুনি জলের ধারা নেমে আসবে।
         আমি এভাবে আর থাকতে পারছিনা । আমাকে একটা উপায় খুঁজে নিতেই হবে। কিন্তু আমি কি করি ? ”
           “আমি নিশ্চিৎ এ বিষয়ের পরিবর্তন আসবে ......”
           “অাপনি সত্যি তাই ভাবেন ? আমি এইরকমই আশা করেছিলাম । একটু আগে আমি আপনাকে আমার অসুবিধার কথা বলেছি এবং আপনি এতোটাই সহানুভূতিশীল এবং প্রেরণাদায়ক ব্যবহার করেছেন যে আমি সুস্থ বোধ করছি। সত্যি, পৃথিবীতে এখনও কিছু ন্যায়পরায়ণতা আছে।”
           কিছুদিন পর, সে আবার বিষাদগ্ৰস্থ হয়ে আর একজনকে খুঁজে পেয়েছিল যাকে সে আবার তার দুঃখের ঘটনা মেলে ধরলো ।
           “প্রভু ” সে চোখের জলে বর্ণনা করলো, “আপনি জানেন, আমি যেখানে থাকি তা শুয়োরের খোঁয়াড় অপেক্ষা খারাপ । আমার মনিব আমার সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করেন না তিনি তার কুকুরের সঙ্গে দশ হাজার গুণ ভালো ব্যবহার করেন  ………..”।
          “এমন কিছু করো যাতে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন।” তিনি এতো জোর দিয়ে শপথ করালেন যে ক্রীতদাস স্তম্ভিত হয়ে গেল। আসলে এই লোকটি ছিল বোকা !
          “আমি যেখানে থাকি তা একদম ভগ্ন, একটিমাত্র কুটির, স্যাঁতস্যাঁতে , ঠাণ্ডা এবং সর্বত্র ছারপোকার নৃত্য । যখন আমি শুয়ে থাকি তখন তারা আমায় লোলুপ হয়ে গ্রাস করে। সমস্ত ঘরটি দুর্গন্ধময়, একটিও জানলা নেই...”
          “তুমি তোমার মনিবকে বলতে পারোনা ওখানে একটা জানলা তৈরি করে দিতে ”
           “কেমনভাবে বলবো ?”
           “ঠিক আছে, আমাকে দেখাও ঘরটা কেমন ”
          বোকা লোকটা ক্রীতদাসকে অনুসরণ করলো তার ঘরে,এবং মাটির দেওয়ালে আঘাত করে ভাঙ্গতে লাগলো।
           “একি ! আপনি কি করছেন ?” ক্রীতদাস ভয়কাতর হয়ে পড়লো।
            “আমি তোমার জন্য একটা জানলা খুলে দিচ্ছি।”
            “আপনি এটা করবেন না, আমার মনিব আমাকে শাস্তি দেবেন।”
            “তাকে দিতে দাও,” বোকা লোকটি দেওয়ালে আঘাত করতে লাগলো ।
             “বাচাও ! একজন দস্যু আমার বাড়ী ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে ! তাড়াতাড়ি এসো তা না হলে দেওয়ালটা ভেঙ্গে ফেলবে……..।”
             সে চিৎকার করে ফোঁপাতে লাগলো এবং মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। সমস্ত ক্রীতদাসের দল বোকা লোকটিকে পরাস্ত করলো। চিৎকারের শব্দে জেগে উঠে, যে মানুষটা সব থেকে ধীরে ধীরে শেষে এসে উপস্থিত হল, সে হল মনিব ।
             “একজন দস্যু আমাদের বাড়ী ভেঙ্গে ফেলবার চেষ্টা করছিল। আমি হলাম প্রথম যে সকল কে সচেতন করেছে। আমরা সকলে মিলে তাকে পরাস্ত করলাম।” ক্রীতদাস অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং বিজয়ীর ভঙ্গীতে কথা বলছিল।
            “তোমরা ঠিকই করেছো ।” মনিব প্রশংসা করলো। এই বিশেষ কারণে ঐদিন বহু অতিথি নিমন্ত্রিত হলেন । তাদের মধ্যে ছিলেন ঐ জ্ঞানী ব্যক্তিটি।
           “প্রভু, শেষপর্যন্ত আমি নিজেকে মনিবের কাজে লাগিয়েছি। তাই আমার মনিব প্রশংসা করেছেন । ঐদিন আপনি যখন বলেছিলেন যে এই অবস্থার পরিবর্তন আসবে,...…… আপনি সত্যিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।” সে অত্যন্ত আশা এবং আনন্দ নিয়ে কথাটা বলল ।
           “এটা ঠিকই ।” জ্ঞানী ব্যক্তিটি বললেন এবং এব্যাপারে হয়তো সুখী বোধ করলেন ।  

No comments:

Post a Comment