স্বপ্নের মৃত্যু নেই
বিশ্বজিৎ দাসগুপ্ত
ছত্রিশগড়ের অসংখ্য মানুষের মর্মভেদী হাহাকারকে যিনি নতুন ছত্রিশগড়ের স্বপ্নে উদ্বেলিত করেছেন এবং আত্মপরিচয়হীন এক বিশাল জনসমুদয়ের জাতিসত্ত্বা সংঘর্ষ ও নির্মাণের ভিত্তিতে প্রস্ফুটিত করেছেন, সেই মানবমুক্তিকামী শ্রমিক নেতা শংকর গুহ নিয়োগী, ১৯৯১ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর গভীর রাতে শাসক শ্রেণীর ভাড়াটে ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে খুন হন। জলপাইগুড়ি জেলার এই বিপ্লবী মধ্যবিত্তটির নির্মম হত্যায় সারা দেশ আজ শোকস্তব্ধ।
আমরা - অসংখ্য মধ্যবিত্তমানুষ, ঘটনাটির আকস্মিকতায় বিস্মিত হলেও ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক আলোকে নিয়োগীজী স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন যে তাকে খুন করা হবে । তিনি ক্যাসেটও করে গেলেন " ...এরা ( ভিলাইয়ের শিল্পপতিরা) আমাকে মারবেই। আজ অথবা কাল.....। কিন্তু আমাদের আন্দোলনকে শেষ করা যাবে না।” প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভাল যে ক্যাসেট করার কিছু দিনের মধ্যেই তাকে খুন করা হয় ।
শংকর গুহ নিয়োগী ও তার সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতি নিয়ে আলোচনার পূর্বে মধ্যপ্রদেশের ছত্রিশগড়ী জাতিসত্ত্বার গঠনটি কিরূপ তা জানা প্রয়োজন ।
১ মধ্যপ্রদেশের জেলাগুলির মধ্যে হোল থেকে শুরু করে সরগুজা, বিলাসপুর, রায়পুর, রায়গড়, দুর্গ, রাজনন্দগাও এবং বস্তার হয়ে উড়িষ্যা সম্বলপুর জেলার একটি অংশ অবধি বিস্তৃত অঞ্চলে ছত্রিশগড়ি মানুষের বসবাস ।
২ ইতিহাসের দিক থেকে ছত্রিশগড়ী মানুষের সংখ্যাধিক অংশ নিষাদ গোষ্ঠী হতে উদ্ভূত উপজাতি গোষ্ঠী। বাকী অংশ মূলতঃ দ্রাবিড় ও আর্য গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। মধ্যপ্রদেশের ভূখণ্ডের সংখ্যাধিক মানুষের ভাষা ছত্রিশগড়ী । কারণ এই সকল উপজাতিই ছত্রিশগড়ী মানুষের সাথে সম্মিলনের এক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে ।
ছত্রিশগড়ী অর্থনীতির ভিত্তি
শহরাঞ্চলের শিল্পগুলি মূলতঃ বহুজাতিক সংস্থা, রাষ্ট্ৰীয় পূজি এবং ভারতীয় একচেটিয়া পরিবারগুলির পুজির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। ব্যবসা বাণিজ্য এবং ক্ষুদ্রায়তন শিল্পগুলি মূলতঃ অছত্রিশগড়ীদের ( সিন্ধ্রী , মাড়োয়ারী এবং পাঞ্জাবী) দখলে। সমতল ভূমি মূলতঃ কৃষিভিত্তিক। অধিকাংশ ছত্রিশগড়ী জঙ্গলের মালিক রাষ্ট্র। ঠিকাদার ভিত্তিক জঙ্গুলে ব্যবস্থার যাতাকলে প্রতিনিয়ত দলিত ছত্রিশগড়ের অগণিত মানুষ।
আঁধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক অর্থব্যবস্থার অমানবিক পেষণে নিষ্পেষিত ছত্রিশগড় মানুষ তাদের জাতিসত্ত্বা হারিয়ে যখন বন্য পশুর মত দিনযাপন করছে - সুতীব্র দারিদ্রের ছোয়ায় গরুছাগলের মত মারা যাচ্ছে ঠিক তখনই শংকর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে হাজারে হাজারে মানুষ ছত্রিশগড়ের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে শ্রেণী সংগ্রামের আদর্শে সংগঠিত হতে থাকে ।
একটি মার্কসীয় নির্বাচন
ছত্রিশ গড়ের কর্মরত শ্রমিক শ্রেণীকে দুইটি ভিন্ন বিভাগে ভাগ করা যেতে পারে সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী। মূলতঃ ভিলাই ষ্টিল প্ল্যান্টের কর্মরত শ্রমিক হল সংগঠিত দক্ষ শ্রমিক যাদের মজুরী এবং জীবনযাত্রার মান অপেক্ষাকৃত উন্নত। এছাড়া সমগ্র ছত্রিশগড় জুড়ে রয়েছে অগণিত অসংগঠিত ঠিক শ্রমিক যাদের জীবনযাপন বন্য পশুজীবন অপেক্ষা মোটেই উন্নত নয়।
ভিলাই ষ্টীল প্ল্যাণ্টে (V. S. P, ) দীর্ঘ সাত বছর উৎপাদন সংগ্রামে লিপ্ত এই দক্ষ শ্রমিক শংকর গুহ নিয়োগী অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির সংমিশ্রণে যে উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন তা হল সংগঠিত শ্রমিকদের শ্রেণী সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কারণ V. S. Pর শ্রমিকদের মধ্যে মালিক পক্ষ পূজিবাদী ধ্যানধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ফলে শ্রমিকেরা প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই বর্তমান অবস্থার উন্নতির প্রচেষ্টা চালায়। অর্থনৈতিক দাবীদাওয়ার দুষ্ট চক্রে অনবরত ঘোরাফেরা করে শ্রমিক আন্দোলন। এই জঙ্গী অর্থনীতিবাদী আন্দোলন ধীরে ধীরে শ্রমিকদের মধ্যে সুবিধাবাদ ও সংগ্রাম বিমুখ মনোভাবের জন্ম দেয় এবং তারা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে বিমুখ হয়ে পড়ে। অপরদিকে আছে দারিদ্রের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত কাতারে কাতারে অসংগঠিত শ্রমিক যাদের মধ্যে অর্থনীতিবাদ বা সুবিধাবাদ সম্পর্কিত প্রশ্নটি হাস্যকর। তাই শংকর গুহ নিয়োগী শ্রেণী সংগ্রামের বীজ রোপণ করার উদ্দেশ্যে ও শ্রেণী সচেতনতার লক্ষ্যে বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত ঠিকা শ্রমিককে বেছে নিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার যে উনি শ্রমিক আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর গুরুত্বের অপরিহার্যতা স্বীকার করতেন।
রাজনীতি - সংঘর্ষ ও নির্মাণ
যেখানে ন্যূনতম মজুরীর অভাবে জীবন বিপন্ন সেখানে মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলনের ভি ত গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। শুরু হল লাগাতার আন্দোলন । গড়ে উঠতে লাগলো নানান সংগঠন - ছত্রিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ ( CMSS ), CMSS এর কৃষক বিভাগের পরিচালনায় ছত্রিশগড় মুক্তি মোর্চা, মহিলা মুক্তি মোর্চা প্রভৃতি অসংখ্য সংগঠন। আন্দোলনের দাপটে বেড়ে চলল মজুরী কিন্তু লক্ষ্য করা গেল শ্রমিকদের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হলনা শুরু হল চিরুনী অভিযান । কারণ ধরা পড়ল - মদ্যপান । দেখা গেল জলের কল অপেক্ষা মদের দোকানের আধিক্য ঘটেছে। ।
মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন - একটি আর্থ-সামাজিক আন্দোলন
শংকর গুহ নিয়োগীর প্রতিটি আন্দোলন ভারতীয় ঐতিহ্য এবং স্বদেশী উপাদানে পুষ্ট এক নতুন আঙ্গিকগত আন্দোলন। নিত্য নতুন আঙ্গিকের প্রয়োগ - মানুষের কাছে কখনো তাকে করে তুলেছে ছত্রিশগড়ের গান্ধী কথনো বা আতি ৰাম আবার কখনও বা মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারক। নিত্য নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে যেতেন। তাই শুধু বুদ্ধিকে আশ্রয় করে তাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সবাইকেই গোলক ধাঁধায় ঘুরতে হয়েছে।
মদ্যপানবিরোধী আন্দোলনকে তিনি গান্ধীবাদী সুরে বেঁধে নেন। আসলে প্রকৃত মার্কসবাদী গান্ধীবাদকে কখনো সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলতে পারে না। যে অহিংস আন্দোলন আপামোর ভারতবাসীকে এক করতে সক্ষম হয়েছিল সেই আন্দোলনের ক্ষীরটুকু উপলব্ধি করে তাকে বাস্তবায়িত করার প্রয়োজনীয়তা একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদীর নিশ্চয়ই উপলব্ধি করা উচিৎ যা শংকর গুহ নিয়োগী করেছিলেন। তিনি মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনের চরিত্রটি গান্ধীবাদী আদর্শে শাণিত করেন কারণ যেক্ষেত্রে লড়াইটা শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধেই সেক্ষেত্রে আন্দোলনের উপাদান পুষ্ট হওয়া চাই সহিষ্ণুতায়, অহিংস মনোভাবে। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র গান্ধীবাদের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেন নি। তিনি সর্বক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আক্রমণাত্মক আন্দোলনের পথও খোলা রাখতেন।
ছত্রিশ গড়ের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ল মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হল। মদ্যপানের মাধ্যমে শ্রমিকদের আত্মসম্মানবোধ এবং লড়াইয়ের মানসিকতা কারা কিভাবে, কিসের উদ্দেশ্যে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে তা আদিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে মিটিং, মিছিল ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনা, পোষ্টারিং এর মাধ্যমে CMSS ছড়াতে থাকে | শ্রমিকরা ধীরে ধীরে উপলব্ধির এক স্তরে উন্নীত হয়। হাজারে হাজারে শ্রমিক মদ্যপান পরিত্যাগ করে মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। ।
মজুরী বৃদ্ধির পাশাপাশি মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনের ব্যপক সাফল্য শ্রমিকদের হাতে নিয়ে আসে এক টুকরো অবসর। শ্রমিক পরিবারগুলি নিজেদের নিস্তেজিত জৈবিক তাড়নার বাইরে আর একটি উন্নততর জীবনের তাগিদ অনুভব করে। অবসর সময় যাতে পুনরায় মদের দোকানে ব্যয়িত না হয় তার জন্য গঠনমূলক কাজের প্রয়োজনীয়তা নিয়োগীজী অনুভব করেন। শ্রমিকদের অর্থ ও শ্রমে গড়ে ওঠে কয়েকটি স্কুল । এই প্রথম তারা নিজেদের সন্তানদের জন্য কিছু গড়ার আনন্দ উপলব্ধি করে যা তাদের আত্মপ্রত্যয় অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার সময় বসে গানের আসর। শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা নিয়ে মঞ্চস্থ হতে থাকে নাটক । প্রোজেক্টরের সাহায্যে শ্রমিকদের ভাল ছবি দেখার ব্যবস্থা করা হয়। ধীরে ধীরে কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ধরা পড়ে উজ্জ্বল শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন ।
মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকরা রাজনৈতিক সচেতনতার এক স্তরে পৌছায় তারা দেখে মদের বড় ঠিকাদার সুরজিত সিং ভাটিয়া বিনিয়োগকৃত অর্থও তুলতে পারছে না। আন্দোলনের সাফল্যে কায়েমী স্বাৰ্থ নিয়োগীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ঠিকাদারদের স্বার্থের সাথে যুক্ত হয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ প্রশাসনের স্বার্থ। শুরু হয় নিয়োগীকে খুন করার প্রচেষ্টা। নিয়োগীকে জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে গ্রেপ্তার করা হলে শ্রমিকদের সংগঠিত চাপে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এইভাবে মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। শ্রমিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
মেহনতকশোঁ কে লিয়ে মেহনতকশোঁ কী আপনা কার্যক্রম - শহীদ হাসপাতাল
একদিকে মজুরী বৃদ্ধি অপরদিকে মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনের সাফল্য ও অর্থনীতিবাদী শেকল ভাঙা সংস্কৃতির প্রসার এবং পাশাপাশি ছোট ছোট গঠনমূলক কাজ শ্রমিকদের সচেতনতা বহুগুণ প্রসারিত করে ষার ফলশ্রুতি শহীদ হাসপাতাল । ১৯৮৩ সালে সম্পূর্ণ শ্রমিক অর্থ ও শ্রমে নির্মিত হয় ৪০ বেডের আধুনিক অপারেশন থিয়েটারে সজ্জিত এই হাসপাতালটি, যা আজকে আরো বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে। এটা মনে করা ভুল হবে যে হাসপাতাল স্থাপনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের কেবল সামান্য- অসুখে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান গেছে । হাসপাতাল নির্মান ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে যে বৃহৎ প্রেক্ষাপট শ্রমিকদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে তা হল অন্যান্য হাসপাতালের ন্যাক্কারজনক অবস্থা তথা বর্তমান রাজনৈতিক পার্টির চরিত্র এবং কর্মপদ্ধতির ভূল ক্রটি ও অকর্মন্যতা ।
ছত্রিশগড় মুক্তি মোর্চার জনস্বাস্থ্য আন্দোলনটি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের পরিচালনায় গড়ে ওঠে । স্বাস্থ্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার উপলব্ধি করে যে এই আন্দোলন মেহনতী মানুষের বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের একটি অংশ। দ্বিতীয়তঃ, প্রতিটি স্বাস্থ্য সমস্যাই মূলতঃ আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক সমস্যা, তাই কাঠামোর পরিবর্তন ব্যতীত রোগ প্রতিরোধ অসম্ভব, এবং পরিশেষে স্বাস্থ্য আন্দোলনকে বৃহত্তর আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে না পারলে আন্দোলন ভেঙে পড়তে বাধ্য। এইভাবে সংঘর্ষ ও বিকল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে তারা মার্কসবাদের সারকথা - কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন নয় এই উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হতে থাকে। আগামী শোষণহীন সমাজের ছোট ছোট একেকটা অংশকে বাস্তবায়িত করার অদম্য প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের আস্থা বেড়ে চলে, শ্রমিকরা সংগ্রামে আরো অনুপ্রেরণা পায়।
দ্বিতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার গুরুত্ব প্রসঙ্গে :
সাম্যবাদী চিকিৎসক ডাঃ বি.এস. যদুর সংস্পর্শে এসে তিনি কৃষকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এছাড়া অসংখ্য আদিবাসী যাদের জীবন বিস্তীর্ণ জঙ্গলের সম্পদের উপর নির্ভরশীল তাদের সংখ্যার বিশালত্ব নিয়োগীকে আকর্ষন করে। ছত্রিশগড়ের ভিত্তি আর মজুবতের লক্ষ্যে এই দুই শ্রেণীর যোগদান অত্যাবশক হয়ে পড়েছিল। তাই ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের চারিদিকে সম্ভাবনাময় কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি সক্রিয় হন। আজকের ভারতবর্ষে যেখানে এখন বিপুল সংখ্যক মানুষ কৃষিজীবী সেখানে কৃষক শ্রেণীকে বাদ দিয়ে কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না। তাই শ্রমিকেরা বিভিন্ন ইস্যুতে কৃষকদের পাশে দাড়াতে থাকে। এইভাবে কৃষক-শ্রমিক মৈত্রী গড়ে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা প্রয়োজন যে বর্তমানে ছত্রিশগড়ে শ্রমিকশ্রেণীর উপর পুঁজিপতি শ্রেণীর খর্গহস্ত নেমে আসায় কৃষকেরা আজ প্রকৃত সহযোগী উপাদান রূপে শ্রমিক শ্রেণীর পাশে এসে দাড়িয়েছে।
কার্যক্রম - নিজের গাছকে চেন
জঙ্গল মানুষের পরম বন্ধু। কিন্তু আজকের যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে তা মূলতঃ মুনাফা ভিত্তিক। মুনাফা ভিত্তিক সভ্যতা কখনো মানুষ আর প্রকৃতির সামঞ্জস্য রক্ষা করে অগ্রসর হতে পারে না । ছত্রিশগড়ও এর ব্যতিক্রম নয়। আমলাতান্ত্রিক জঙ্গুলে ব্যবস্থার ফসল ঠিকাদারদের দৌরাত্মে জঙ্গল প্রায় সাফ হতে থাকে। বেআইনী ভাবে বড় বড় গাছগুলি জঙ্গলের বুক চিরে মাটিতে পড়তে থাকে। জঙ্গলে আদিবাসীদের জীবন হয় বিপন্ন। ইউনিয়ন এগিয়ে আসে। প্রতিটি গাছের উপযোগীতা, তার স্থানীয়, হিন্দী ও বৈজ্ঞানিক নাম, পুস্তিকা, আলাপ আলোচনা, পোষ্টারিং-এর মাধ্যমে সর্বত্র প্রবাহিত হয় । অরণ্যের অধিকার দৃঢ় হতে থাকে। আদিবাসীরা অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে জঙ্গলের সাথে পরিচিত হয়। ঠিকাদারদের কোন কোন গাছ কাটার আইনগত অধিকার আছে আর কোন গাছের ক্ষেত্রে নেই - এ বিষয়ে ধারণা স্বচ্ছ হয়। শুরু হয় সংগ্রাম পাশাপাশি বৃক্ষ রোপণ ও বনমহোৎসবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে বিকল্প জঙ্গল নিৰ্মাণ যার প্রভাবে আজ শ্রমিক বস্তিও সবুজ শোভায় ভরে গেছে ।
নিয়োগী - একটি আন্দোলনের নাম
CMSS গঠনের ঠিক পরমুহূর্তেই শ্রমিকদের উপর নেমে আসে আঘাত— নষ্ট হয় এগারোটি প্রাণ। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে হারায় বেশ কিছু প্ৰাণ । তারপর - সময় ধীরে হেঁটে যায়, খুন হন শংকর গুহ নিয়োগী। অবশেষে জালিনওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডকে বিস্মিত করে ১৯৯২ এর জুলাইতে আন্দোলনরত ১৬ জন শ্রমিককে বুলেটের ঘায়ে ঝাঁঝরা করা হয় - বুলেট বিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষতে থাকে আরও ২৪ জন শ্রমিক। তাদের অপরাধ তারা নিয়োগীর হত্যাকারীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছিলেন । নিয়োগীর স্ত্রী আশা গুহ নিয়োগী তাদের আন্দোলনের খুঁটি শক্ত করতে ভারত ভ্রমণে যান । আজকে নিয়োগী নেই তা বলে আন্দোলন কিন্তু থেমে নেই। তাই মনে হয় নিয়োগীজী কোন ব্যক্তি হিসাবে নয় যেন এক আন্দোলন রূপেই শ্ৰমিক সত্ত্বায় বিরাজমান ছিলেন। ।
[ তথ্যসূত্র : সংঘর্ষ ও নির্মাণ
সম্পাদনা : পূর্ণেন্দু বসু ও শংকর সান্যাল ]
আরব্ধ ২য় সংখ্যা , অক্টোবর ১৯৯২।
No comments:
Post a Comment