Wednesday, 13 January 2016

ওরা কাজ করে : ঐকতান ( রিষড়া) : সঞ্জয় রায়, বিশ্বজিৎ দত্ত

ওরা কাজ করে :  ঐকতান ( রিষড়া)
সঞ্জয় রায়, বিশ্বজিৎ দত্ত

''বিশ্ব যখন নিদ্রামগন
      গগন অন্ধকার 


কে দেয় আমার বীণার তারে
     এমন ঝংকার ।…….''
                    -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (গীতাঞ্জলি)


      সত্যি আজ চারদিকে তাকিয়ে দেখি আমরা যেন ক্রমশ গণ্ডীবদ্ধ হয়ে পড়ছি। সমস্ত জায়গা থেকে আমাদের বিশ্বাস ভেঙে পড়ছে, অবশেষে আমাদের পিঠ ঠেকছে আমাদের “অামিত্ব"-তে। এই “আমি”-র গণ্ডীতে বন্দী হয়ে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি সমাজ থেকে, আমাদের পাশের মানুষ জনের থেকে ।
       কিন্তু মানুষ বোধহয় এত তাড়াতাড়ি হেরে যেতে পারে না, তাই সে লড়াই  করে এই আমিত্বের পঙ্কিল আবর্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য । সে স্বপ্নদেখে এক নতুন সমাজের, যে সমাজে মানুষেরই জয়গান ঘোষিত হবে।
       আমাদের পত্রিকার এই কলামের মাধ্যমে আমরা পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে এমন একটি সংগঠনের (ঐকতান ) পরিচয় করিয়ে দিতে চাই যারা তাদের সীমিত সামর্থে মানুষের এই লড়াইয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে ।
       ঐকতান সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে প্রথমে চলে যাই একেবারে গোড়ার দিকে অর্থাৎ যবে থেকে ঐকতান প্রতিষ্ঠিত হল । আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে রিষড়ার একটি ছোট্ট অঞ্চলে সংগঠনটি জন্ম নেয় । তখন এটি নয় জনের একটি গণসঙ্গীতের গ্রুপ ছিল। গণসঙ্গীত ছাড়াও গ্রুপটি আরও কাজ করার কথা ভাবছিল। ঠিক তখনই সেই অঞ্চলের অন্য আর একটি গ্রুপ তারাও ভাবছিল কাজ করার কথা। অত:পর দুটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে ঐকতান একটু বড় রূপ নেয়। ঐকতানের সদস্য সংখ্যা তখন হয়ে যায় পচিশ থেকে তিরিশ জন । এই ২৫-৩০ জন যুবক মিলে ঠিক করল,— যে সকল ছাত্রের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ তাদের জন্য একটা Free কোচিং খুলে তাদের দিয়ে কাজ শুরু করবে।
     এরপর রিষড়ার বিভিন্ন জায়গায় (মূলত বিভিন্ন স্কুলে তাদের কোচিং সম্পর্কে পোষ্টারিং করে এবং প্রথম বছর মাত্র 13 জন ছাত্র নিয়ে তাদের এই কোচিং শুরু হয় (প্রথম বছর মুলত ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হত )

        এরপর ঐকতান সময়ের সাথে নিজেকে কাজের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে —  

     (i) অঞ্চলে পরিবেশ দূষণের উপর পোষ্টারিং করা।

     (ii) নিজেরা একটা বিজ্ঞান Unit খুলে বিভিন্ন অঞ্চলে বিজ্ঞান মেলা করে লোকজনকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা।
     (iii) কুসংস্কার বিরোধী পোষ্টার তৈরী করে জনবহুল অঞ্চলে লাগান।
     (iv) ড্রাগ বিরোধী পোষ্টারিং করা।  
     (v) পর্ণ সিনেমার বিরুদ্ধে সিনেমা হলে পোষ্টারিং এবং street Corner করা।
     (vi) গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে প্রচার করা ।
     এই সব কাজের সাথে সাথে ঐকতানের মূল ইস্যু অর্থাৎ কোচিংটাও কিন্তু বড় হতে থাকে। তিন বছরের মাথায় ছাত্র সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১০০ জন । (তখন শ্রেণীও বেড়ে দাড়িয়েছে প্রথম - দ্বাদশ ) । আমরা অর্থাং আরব্ধ-র কর্মীরা বেশ কিছুদিন এই সংগঠনের কাজকর্ম দেখে আসছি। আমাদের বেশ মনে আছে, আমরা যেবার ঐকতানের সাথে প্রথম যোগাযোগ করতে যাই সেদিন আমরা সকলে অবাক হয়ে দেখি কিছু যুবক ছেলে নিঃস্বার্থভাবে তাদের সময়কে ব্যয় করে Free কোচিং সেন্টারে পড়াচ্ছে। বিষয়টা আমাদের সকলের ভীষণ ভাল লাগে। মনে হয়, ভাল কাজ করার লোক এখনও আছে।
     আমরা যারা এইরকম ছোট ছোট গ্রুপ বা পত্রিকা চালিয়ে থাকি বা এইরকম গ্রুপের সাথে যুক্ত আছি তারা জানি যে এইরকম গ্রুপগুলির আর্থিক অবস্থা কি ভয়ানক। সেই দিক থেকে ঐকতানেরও আর্থিক অবস্থা একইরকম। সক্রিয় কর্মীরাই নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে সংগঠনের খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। কোচিং সেন্টারের এককাঠা জমিটাও একজন কর্মী সংগঠনকে দিয়েছে ।
      ঐকতান বর্তমানে অনেক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে, বেশ কিছুদিন
আগেই অযোধ্যায় রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সময়  ঐকতান এর প্রতিবাদে street Corner, মিছিল ও লিফলেট বিলি করে এবং অঞ্চলে একটি কনভেনশনের আয়োজন করে ।
     এছাড়া, শঙ্কর গুহ নিয়োগী কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছত্রিশ গড়ে যে কাজকর্ম করে যান সেই কাজকর্মের সাথে অঞ্চলের জনগণের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ও ঐকতান নিয়েছিল, এই বিষয়ে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে দেওয়াল লিখন ও মিটিং করে ।
      রিষড়া অঞ্চলে সেবাসদন নামে, একটি ছোট হাসপাতাল (বেসরকারী) রয়েছে। আর্থিক অনটনের দরুন হাসপাতালটির বর্তমান অবস্থা খুব খারাপ । ঐকতানের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে আমরা বলতে পারি তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসাবে – রিষড়া অঞ্চল জুড়ে ছোট বড় যে কয়টি কলকারখানা রয়েছে তাদের থেকে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ জোগাড় করে এলাকার হাসপাতালটিকে নতুন করে দাঁড় করাবার ইচ্ছে এদের মধ্যে রয়েছে।
       আজ থেকে চার বছর আগে নয়জন মিলে শুরু করা সেই ছোট্ট গ্রুপটি আজ অনেকটা বড় হয়েছে, ঐকতানের বর্তমানে সদস্য সংখ্যা প্রায় 100 জন। এবং সেই কোচিংটার ছাত্র সংখ্যা 140 জন (Class I – BCom. ), এছাড়া ওরা আবৃত্তি, নাটক ও গণসঙ্গীত করে ।
      অাজকের এই অবক্ষয়ী ও আত্মকেন্দ্রীক যুব সমাজের বুকে দাড়িয়ে এতগুলো যুবক ভাল কিছু করার জন্য এগিয়ে আসছে, সমাজকে নতুন কিছু দেবার কথা ভাবছে। এই প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। আরব্ধর তরফ থেকে ঐকতানকে জানাই অভিনন্দন ।


(১৯৯২ সালে প্রকাশিত)

No comments:

Post a Comment